‘নৈতিকতার অবক্ষয়ে রমজানেও অতি মুনাফা আদায়’
সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম কমেছে। কিন্তু অন্যান্য বছরের মতো বাংলাদেশের চিত্র এবারও ভিন্ন। দেশে চাল, ডাল, তেল, চিনির পর্যাপ্ত সরবরাহ ও মজুদ রয়েছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকেও বারবার জানানো হয়েছে যে কোনো জিনিসের দাম বাড়বে না। তারপরও দেশীয় পণ্য থেকে শুরু করে আদমানিকৃত কোনো পণ্যের দাম তো কমেনি বরং রমজানের প্রথম দিনেই বেগুন, লেবু, মরিচের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আদার দামও অনেক বেড়ে গেছে। চাল, ডালের দামও কমছে না। বাজার থেকে দেশি চিনি হাওয়া। আমদানিকৃত চিনির দামও অনেক বেড়ে গেছে। নিয়ম ভঙ্গ করে অতি মুনাফার লোভে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা বেশি দাম আদায় করছে, ভোক্তাদের পকেট কাটছে। তাদের নীতি নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণেই এই দুরাবস্থা বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
রমজান মাস আসলে প্রতি বছর নিত্য পণ্যের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। এ সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেই সরবরাহের সংকট দেখিয়ে বেশি মুনাফা করে ভোক্তাদের কাছে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করে। এবারও সয়াবিন তেলের সংকট দেখিয়ে সবেবরাতের আগে ৫ লিটার ৮০০ টাকায় বিক্রি করে। এ নিয়ে দেশে হই-চই পড়লে সরকার ট্যাক্স ভাট কমিয়েছে। তারপরও লিটার ১৬০ টাকার কমে পাওয়া যায় না।
কয়েক মাস থেকে প্রায় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরাও নড়েচড়ে বসে। তারা সব খাতের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বলেছেন, দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। সরবরাহও স্বাভাবিক পর্যায়ে। তাই রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে না। আশ্বস্ত করেছেন এসব পণ্যের উৎপাদক ও সরবরাহাকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।
সর্বশেষ গত শনিবারও (২ মার্চ) রমজানের আগের দিন এফবিসিসিআইর উদ্যোগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মজুত, আমদানি, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি বিষয়ক মতবিনিময় সভা করে আশ্বাস দেন ব্যবসায়ীরা কোনো জিনিসের দাম বাড়বে না। শুধু তাই নয়, রমজানে বাজার স্বাভাবিক রাখতে এফবিসিসিআই’র পক্ষ থেকে ৪৬ সদস্য বিশিষ্ট বাজার মনিটরিং কমিটি গঠনও করা হয়েছে। ৪৬টি পণ্য সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে কি না তা তদারকি করবে কমিটির সদস্যরা বলে জানানো হয়েছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও বলেছেন, ‘বাজারে প্রতিটি পণ্যের মজুদ চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। ভোজ্যতেল, ডাল, চিনি, সোলা, মসলাসহ সকল পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। ঘাটতির কোন সম্ভাবনা নেই।’
কিন্তু চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী। বাজারে সেই চিত্র দেখা গেছে। রমজানের প্রথম দিনই প্রায় জিনিসের দাম বেড়ে গেছে।
রবিবার (৩ মার্চ) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সরেজমিনে দেখা যায়, তিনদিন আগে বেগুনের কেজি ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। কিন্তু প্রথম রমজানে সেই বেগুনের কেজি হয়েছে ১০০ টাকা। ৬০ টাকার ডজন লেবু বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা। যা তিন দিন আগে ৬০ টাকা ডজন। শসার দাম দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে। তিন দিন আগের ৪০ টাকার শসা কেজি ৮০ টাকা হয়েছে। আর ৫০ টাকার মরিচের কেজি ১০০ টাকা হয়েছে। আদার দাম ও সামান্য বেড়ে গেছে। দেশি আদা আগে ৭০ টাকা বিক্রি করা হলেও তা ৯০ টাকা, চায়না আদা ১২০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি বিক্রি করেন বিক্রেতারা।
বছরে ২০ লাখ টন সয়াবিন তেল লাগে। মাসে লাগে গড়ে এক লাখ ২০ হাজার টন। তবে রমজানে আড়াই লাখ টন লাগে। কিন্তু সরবরাহ বেশি থাকলেও বাজারে এখনো খোলা তেল পাওয়া না বলে বিক্রেতারা অভিযোগ করে জানান।
কারওয়ান বাজারের ইউসুফ জেনারেল স্টোরের মালিক ইউসুফ ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে সয়াবিন তেলের দাম ৫ লিটার ৮০০ টাকা থেকে কমে ৭৬০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। তবে খোলা সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না।’
বিভিন্ন উদ্যোগেও রমজানে কমছে অনেকে পণের দাম। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘নিয়ম আছে ব্যবসা করতে হলে তা মানতে হবে। এটা বলা সহজ। কিন্তু বাস্তবতা খুবই কঠিন। কারণ, আমাদের অনেক নিত্যপণ্য আমদানি করতে হয়। পুঁজি বিনিয়োগ করেই ব্যবসা করতে হয়। তাই লাভ তো করতে হবে। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার সুযোগ নেয়। তবে শুধু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এ কাজ করে না, বড়রাও করে। সয়াবিন তেল কত না হই-চই হলো। এরফলে মিলমালিকদেরও ভোক্তা অধিদপ্তরে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে। কিন্তু শাস্তির মাত্রা কি হয়েছে তা কি কেউ বলতে পারবে? অথচ কারওয়ান বাজারে তরমুজের দাম বেশি নেওয়ায় অনেককেই শনিবার তাৎক্ষনিকভাবে জরিমানা করা হয়েছে।’
সৌদি আবরসহ অনেক দেশ রমজানে কমিয়েছে পণ্যের দাম। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তাদের আয় আর আমাদের আয় এক নয়। তাইতো রমজানে বেশি বিক্রির সুযোগ নিয়ে বেশি লাভেরও চেষ্টা করে। অনেকে নিয়ম নীতির তোয়াক্তা করে না। নীতি নৈতিকতার অভাবেই তারা ভোক্তাদের কাছে বেশি লাভ করে থাকেন।’
এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেছেন, ‘ব্যবসায়ীরা পাকা রশিদ ব্যবহার না করায় অনেকে বেশি দাম আদায় করছে। এটা করা হলে ভোক্তাদের কাছে বিক্রেতারা বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে না। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে পাকা রশিদ মানতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
এ ব্যাপারে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘কোভিড ও রাশিয়া ইউক্রেন পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্যের দাম ও জাহাজ ভাড়া প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তবে ঘোষণার দিনই কেন বাড়বে? এলসি খোলার দুই মাস পর দাম বাড়বে বাজারে। এ ছাড়া দেশি পণ্যের দাম তো বাড়ার কথা নয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য বদনাম হয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরবসহ সারাবিশ্বে উৎসবকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম কমান। তাই বাংলাদেশেও এমন সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। আমাদেরও উচিৎ পবিত্র রমজান মাসে পণ্যের দাম কমাতে হবে।’
এদিকে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুয়ামূন বলেছেন, বাংলাদেশের সরকারি ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ১৪টিই লোকসানে। এর মধ্যে একটি চিনিকল (কেরু অ্যান্ড কোং) লাভজনক ও অলাভজনক চিনিকলের সংখ্যা ১৪টি। দেশি চিনির ব্যাপক চাহিদা থাকলেও বাজারে তা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কোথায় পাওয়া গেলেও ৭০ টাকা কেজির চিনি ভোক্তাদের ১০০ টাকায়ি কিনতে হচ্ছে। এর প্রভাবে আমদানিকৃত চিনির দামও অনেক বেড়ে গেছে।’
কারওয়ান বাজারের মায়ের দোয়া স্টোরের শামিম বলেন, ‘ আগে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজি চিনি বিক্রি করা হলেও বর্তমানে প্যাকেট কেজি ৮৫ টাকা ও খোলা চিনির কেজি ৭৬ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে।’
জেডএ/এমএমএ/