মোকাম থেকে খুচরা দামে ফারাক তিনগুণ
![](https://admin.dhakaprokash24.com/logo/placeholder.jpg)
আলুর ক্ষেতে (জমিতে) ৫ থেকে ৬ টাকা কেজি আলু। তাও কেনার লোক নেই। জমি থেকে উঠার খরচই উঠছে না। বিঘাতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লোকসান। কারণ প্রতি বিঘা আলু চাষে খরচ হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। বর্তমানে অর্ধেক দামেও কেনার লোক পাওয়া যায় না। তাই কৃষকরা জমি থেকে আলু তুলতেও চাচ্ছে না। একেবারে দিশেহারা কৃষকরা। এভাবেই ক্ষেত ও মোকামে আলুর বাজারের শোচনীয় অবস্থার কথা ঢাকাপ্রকাশকে জানান ঠাকুরগাও জেলার হরিপুর থানার মেদনীসাগর গ্রামের মো. মামুন।
সেই আলু রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন আড়তে ১০ থেকে ১১ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আর খুচরা বাজারে ১৫ থেকে ২০ টাকা। পুরাতন আলু বিক্রি করতে না পারায় দুই হাজার ১১২ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে কৃষক, ব্যবসায়ী ও কোল্ডস্টোরেজ মালিকদের। সরকারের উদ্যোগ ছাড়া আলুর দাম বাড়ানো সম্ভব নয়। আলুর মতো টমটোরও খারাপ অবস্থা। ক্ষেত্রে কম দামে বিক্রি হলেও ঢাকাতে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছে খুচরা ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন বাজার ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এমনই তথ্য জানা গেছে।
শুধু ঠাকুরগাও নয়, দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, মুন্সিগঞ্জসহ সারা দেশে আলুর একই দুরাবস্থা বলে সংশ্লিষ্ট কৃষক ও ব্যবসায়ীরা জানান।
তাদের কথার সত্যতা জানতে যোগাযোগ করা হলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি বাজার জনতা বাণিজ্যলয়ের ইকবাল হোসেন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘ডাইমন্ড আলুর কেজি কেনা হয়েছে ১১ টাকা কেজি। আর বিক্রি করা হচ্ছে ৭০ টাকা পাল্লা (৫ কেজি) বা ১৪ টাকা কেজি। কয়েক দিন থেকে বর্তমানে একটু দাম বেশি। তারপরও লোকসানে চলতে হচ্ছে। মরার মতো অবস্থা। গত ১৯ বছরের ব্যবসা জীবনে এতো খারাপ অবস্থা হয়নি। কারণ হিসেবে মুন্সিগঞ্জের এই আলু ব্যবসায়ী ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘বেশি দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করা যায়। বর্তমানে কৃষকরাই তো ক্ষেতে দাম পাই না। তাহলে আমরা কিভাবে বেশি দামে বিক্রি করব।’
বাজার এতো খারাপ অর্থাৎ কম দাম কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পুরাতন আলু এখনো কোল্ডস্টেরেজে। তাইতো নতুন আলু ঢুকানো যাচ্ছে না। তবে লাল আলুর দাম একটু বেশি। মেহেদী হাসান জানান, ‘১৫ টাকা কেজি কিনে ২৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।
একই বাজারের সোনার বাংলা বাণিজ্যলায়ের মো. রাকিম বলেন, ‘বর্তমানে বাড়তি আলুর বাজার। পাইকারী ১০ থেকে ১১ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। আগে ছিলো ৯ থেকে ১০ টাকা। তবে বাছাই করা খুব ভালো মানেরটা ১৪ থেকে ১৫ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, একই আলু পাশেই প্রতি কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা বেশি দামে খুচরা বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।
তা জানতে পাশের সুজনের কাছে আলু কতো টাকা কেজি এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন,’১৬ টাকা, বাছাই করা বেশি ভালোটা ২০ টাকা কেজি। পাইকারিতে কম। তাহলে খুচরাইিএতো বেশি কেন? এমন উত্তরে তিনি বলেন, বেশি দামে কেনা। সঙ্গে বিভিন্ন খরচা আছে। লাভ তো করতে হবে। একই কথা জানান আবুদল খালেক। তিনি ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, রাত থেকে সকাল ৮টার মধ্যে আড়তদারের বিক্রির পরে পাইকারি ১১ টাকা কেজি ও খুচরা ১৬ টাকা কেজি আলু বিক্রি করা হয়।
আলুর এতো খারাপ বাজার কেন? জানতে চাইলে ঠাকুরগাওয়ের মামুন বলেন, ‘এবার আলুর আবাদ বেশি হয়েছে। সরবরাহ বেশি। আবার পুরাতন আলুই কোল্ডস্টোরেজে থেকে গেছে। সেগুলোও লোকসান করে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ প্রতি ট্রাকের ভাড়া ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা। প্রতি বস্তায় ৬০ থেকে ৬৫ কেজি আলু ধরে। তাতে প্রতি কেজিতে খরচ পড়ে দেড় থেকে এক টাকা ৭৫ পয়সা। সঙ্গে ঢাকাতে আড়ৎদারী এক টাকা এবং বস্তা ও মজুরিতে আরও এক টাকা খরচ হয় প্রতি কেজি আলুতে। এভাবে সব ঝামেলা মোকাবেলা করে ঢাকার বিভিন্ন আড়তে আলু পৌছাতে হয়। তারপরও চাহিদা নেই। নিতে চাই না। প্রতি কেজি আলু ঢাকায় ১০ কেজিও বিক্রি হয় না।
তাহলে এভাবেই ক্ষেতে পড়ে থাকবে আলু, দাম বাড়বে না? এমন প্রশ্নের উত্তরে মামুন বলেন, ‘ মাস খানেক পর আলু একটু আরও পুষ্ট হবে। তখন কোল্ডস্টোরেজে রাখার মতো হবে। স্টক করা শুরু করলে একটু দাম বাড়তে পারে। বাজার কিছুটা চড়া হতে পারে।’
কৃষি বিপণন অধিদফতরের সূত্র মতে, কৃষক পর্যায়ে এক কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয় ৭ টাকা ৬০ পয়সা। সেই পণ্য উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যায়ে আসতে বেশ কয়েকটি ধাপ পেরুতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে- স্থানীয় ব্যবসায়ী, স্থানীয় মজুদদার, স্থানীয় খুচরা বাজার, ব্যাপারি, পাইকারি ব্যবসায়ী, কেন্দ্রীয় বাজার বা টার্মিনাল, আড়তদার, প্রক্রিয়াজাতকারী, খুচরা বাজার, খুচরা ব্যবসায়ী। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজিও রয়েছে।
সার্বিক ব্যাপারে জানতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘আলুর দাম কম থাকলে সরকারের ভালো। তাইতো গত আগষ্ট থেকে কৃষিমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে বারবার ধরনা দেওয়া হয়েছে। তারপরও কোনো উদ্যোগ নেয়নি। পুরাতন ৪০ লাখ বস্তা আলু ফেলে দিতে হয়েছে। প্রতি বস্তায় আলু ছিলো গড়ে ৬০ কেজি। আট টাকা কেজি ধরলে এসব আলুতে দুই হাজার ১১২ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে কৃষক, ব্যবসায়ী ও কোল্ডস্টোরেজের। তারপরও সরকারের মাথা ব্যথা নেই। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘২০২০ সালে দাম বাড়লে তখন র্যাব, ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু বর্তমানে উৎপাদন খরচের অর্ধেকও দাম নেই তাতে কোনো মাথা ব্যথা নেই।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে সাতটি কোল্ডস্টোরেজের এই মালিক বলেন, ‘সরকার সুযোগ না দিলে এক সময়ে কৃষক আলু চাষ করা বন্ধ করে দিবে। তখন ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে বেশি দামে ভোক্তাদের কিনতে হবে। অনেকে এটা চাচ্ছে বলেই কোনো উদ্যোগ নেই না।’ তিনি আরও বলেন সারা দেশে প্রায় চারশটি কোল্ডস্টোরেজ রয়েছে। তাতে সব আলু ধরবে না। সরকারের উদ্যোগ ছাড়া বাড়বে না আলুর দাম।’
আলুর পথেই টমেটো:
এদিকে টমোটোর দামের অবস্থাও আলুর মতো। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কৃষক ও ব্যবসায়ী শাহজাহান বলেন, বৃষ্টিতে অনেক টমোটোর ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া মৌসুম শেষ হয়ে আসছে। তারপরও কম দামেই বিক্রি হচ্ছে টমোটো। আড়তে ১০ থেকে ১২ টাকার বেশি কেজি নিতে চাই না। শুধু গোদাগাড়িতে নয়, বানেশ্বরসহ অন্যান্য বাজারেরও একই দশা। কম দামে বিক্রি হচ্ছে টমেটো।
কিন্তু সেই টমেটো রাজধানীর বিভিন্ন পা্ইকারি ও খুচরা বাজারে দ্বিগুণ দামে অর্থাৎ ৩০ টাকা কেজি পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। সরেজমিনে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে। কারওয়ান বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী মো. আনোয়ার এ প্রতিবেদককে জানান, ‘পাইকারী কেনা হয়েছে ২০ টাকা কেজি। খুচরা বিক্রি করা হচ্ছে ৩০ টাকা। সময় শেষ হয়ে আসছে। তাই দাম আর কমবে না।
টমোটোর খুচরা-পাইকারি দামের ব্যাপারে একই বাজারের চাঁদপুর বাণিজ্যালয়ের মেহেদী হাসানও জানান.‘পাইকারী কেনা হয়েছে ১৫ টাকা কেজি। তা খুচরা বিক্রি করা হচ্ছে ২২ থেকে ২৫ টাকা কেজি। একই কাজারের খুবচরা ব্যবসায়ী করিম বলেন, ‘৩৫০ টাকা ক্যারেট (৩০ কোজি) টমেটো কেনা হয়েছে। তাতে প্রতি কেজিতে ১২ টাকার কম হয়। তা খুচরা ২০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। আর নৌকিব বলেন, ৪০০ টাকা ক্যারেট (৩০ কোজি) কিনে ১১০ টাকা পাল্লা (৫ কোজি) বা ২২ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। তাতে লাভ খুব বেশি নেই।‘
জেডএ/
![Header Ad](https://admin.dhakaprokash24.com/images/single-post-anniversary.jpeg)