উৎপাদন বেশি সত্ত্বেও যে কারণে পেঁয়াজের দাম লাগামহীন
দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ মেট্রিক টন। এবার উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টন। এটা চাহিদার চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি। তারপরও পেঁয়াজের দাম লাগামহীন। কারণ মজুদদারি। কৃষকের কাছ থেকে পেঁয়াজ কিনে মজুদ করে ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছেন বেপারিরা।
জানা যায়, রমজান মাসে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ লাগে ৫ লাখ টন বা মোট চাহিদার ২০ শতাংশ। রমজান মাসে পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন পেঁয়াজের ভরা মৌসুম। তারপরও ঈদের পর থেকেই লাগামহীন হয়ে গেছে পেঁয়াজের বাজার।
গত সপ্তাহে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও বর্তমানে তা ৭০ থেকে ৭৫ টাকা খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদে কৃষকরা পেঁয়াজ বিক্রি করে দিয়েছে। বেপারিরা মজুদ করে ইচ্ছামতো বাড়াচ্ছে দাম। তাই আমদানি করা না হলে কমবে না পেঁয়াজের দাম।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, টাউনহল, কৃষিমার্কেটসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।
পেঁয়াজের দামের ব্যাপারে জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের বিক্রমপুর ভান্ডারের মালিক সবুজ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, গত সপ্তাহে পেঁয়াজের কেজি ৫৫ টাকার কম বিক্রি করা হয়েছে। বর্তমানে তা ৬৭ টাকা। এটা ভালো মানের পাবনা ও রাজশাহীর পেঁয়াজ।
মেসার্স মাতৃভান্ডারের কামাল শেখও বলেন, ঈদের পর থেকেই পেঁয়াজের দাম বেড়েই যাচ্ছে। গত সপ্তাহের ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা কেজির পেয়াজ বর্তমানে ৬৫ থেকে ৬৭ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। বেড়েই যাচ্ছে দাম।
কারণ জানতে চাইলে এসব আড়তদার দাবি করেন, তারা শুধু আড়তদারি পান। দাম কে নির্ধারণ করে এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, দেশের বিভিন্ন মোকাম থেকেই দাম বেঁধে দেয়। আমরা শুধু কেজিতে কমিশন পাই। তারা (বেপারিরা) বলছে উৎপাদন নাকি কম হয়েছে, তাই বাড়ছে দাম।
একই পেঁয়াজ একটু দূরের পাইকারি পর্যায়ে ৩৫০ টাকা পাল্লা বা ৭০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু ভোক্তাদের তা পেতে খুচরা বাজারে আরও ৫ টাকা বেশি গুণতে হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজারের জসিম বলেন, ভালোটা ৭৫ টাকা কেজি, ফরিদপুরেরটা ৭০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। আমরা বেশি দামে কিনছি, তাই বেশি দামে বিক্রি করছি। শুধু এই ব্যবসায়ী নয়, অন্যান্য খুচরা ব্যবসায়ীদেরও একই বক্তব্য। মোকামে দাম বেশি। তাই বেশি দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
শুধু এই বাজারে নয়, কৃষিপণ্যের পাইকারি বাজার কৃষিমার্কেটেও দেখা গেছে বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে। যা রমজান মাসের দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদে কৃষকরা পেঁয়াজ বিক্রি করে দিয়েছে। বিভিন্ন মোকামে বেপারির কাছে মজুদ হয়ে আছে। তারা মাচা করে জমিয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে।
ব্যাপক উৎপাদনের পর ঈদের পরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দাম। জানতে চাইলে শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ৎ বণিক সমিতির সভাপতি মো. সাইদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বিশ্বাস করেন আমরা দাম বাড়াচ্ছি না। আমরা মজুদ করেও রাখছি না। তা রাখা সম্ভবও না।
তাহলে কারা দাম বাড়াচ্ছে? এ ব্যাপারে দীর্ঘ দিনের ব্যবসার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মো. সাইদ বলেন, ঈদের আড়তে ২৩ থেকে ২৫ টাকা কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করেছি। বর্তমানে ৫২ থেকে ৫৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। কৃষকের টাকা দরকার হওয়ায় তারা পেঁয়াজ বিক্রি করে দিয়েছে। তাদের মাল শেষ।
মো. সাঈদ অভিযোগ করে আরও বলেন, পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুরের বড় বড় বাজারের বেপারিরা ঘরের মধ্যে কয়েকটা মাচা করে মজুদ করে রাখছে। ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে। এ জন্যই দাম বাড়ছে। তারাই দাম নির্ধারণ করে দেয়। আমরা বেপারির কাছে ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে কেজিতে শুধু এক টাকা কমিশন পাই। আড়তে বিক্রি হলেই তারা টাকা নিয়ে যায়।
এদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবিও বলছে, বর্তমানে (১৪ মে) প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা। যা ৭ দিন আগে ছিল ৬০ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। আর এক মাসে বেড়েছে ৮৫ শতাংশ। কারণ রমজান মাসেও ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। শুধু তাই নয়, গত বছরের এই দিনেও পেঁয়াজের কেজি ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। বেড়েছে ৫৩ শতাংশ পর্যন্ত।
আর ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্র উল্লেখ করে বলছে, দেশে এবার রেকর্ড পরিমাণ ৩৪ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। যা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি। দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন। এরমধ্যে রমজান মাসে সবচেয়ে বেশি ৫ লাখ টন ব্যবহার হয়। অন্যান্য মাসে গড়ে পোনে দু্ই লাখ টন লাগে।
কিন্তু রমজান মাসে ২০ শতাংশ ব্যবহার হলেও প্রতি কেজির দাম ছিল ৪০ টাকার নিচে। অথচ কম চাহিদা থাকলেও বেপারিরা ইচ্ছামতো দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছে।
এদিকে, ঈদের পর থেকেই পেঁয়াজের দাম হুহু করে বাড়তে থাকায় কৃষি মন্ত্রণালয়ও নড়েচড়ে বসেছে। কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তার রবিবার (১৪ মে) বলেন, কয়েকদিনের মধ্যেই পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেবে সরকার। কৃষকের স্বার্থ বিবেচনা করে পেঁয়াজ আমদানি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। আমরা দেশের অভ্যন্তরে পেঁয়াজের বাজার সবসময় মনিটর করছি। এই মুহূর্তে বাজারে পেঁয়াজের দাম কিছুটা বেশি। তাই কয়েকদিনের মধ্যেই পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত দুই বছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে ১০ লাখ টনেরও বেশি। এ বছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। বর্তমানে মজুদ রয়েছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টন।
আরইউ/আরএ/