নতুন লাইসেন্স ও নবায়নে কাটছে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য
অবশেষে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য থেকে বের হতে যাচ্ছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের দীর্ঘ দিনের দাবির প্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত লাইসেন্স নবায়নের মেয়াদ এক বছরের বদলে পাঁচ বছর করার কথা জানিয়েছে।
সম্প্রতি (১৪ মার্চ) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সবায় এ সংক্রান্ত একটি নথি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অবশ্য এ জন্য সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ কথা জানা গেছে।
বিদ্যমান আইনে দেশের ব্যবসায়ীদেরকে অন্তত আটটি প্রতিষ্ঠান থেকে লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। এর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি করতে গেলে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, কল-কারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং আমদানি-রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। এক বছরের জন্য দেওয়া এসব লাইসেন্স বছর শেষে আবার নবায়ন করতে হয়।
কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে যখন এই আট প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যবসায়ীরা নতুন লাইসেন্স করেন বা নবায়ন করতে যান তখন তাদেরকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। লালফিতার দৌরাত্ম্যে দিনের পর দিন এসব দপ্তরে হাঁটতে হয়। এতে ব্যবসায়ীদের অনেকেই এক সময় হাল ছেড়ে দেন। আবার নবায়নের ক্ষেত্রে দেখা যায়, এক দপ্তর থেকে দুই মাস সময় ব্যয় করে লাইসেন্স নবায়ন করেছেন তো আরেক দপ্তর থেকে নবায়ন করতে তিন মাস কিংবা তারও বেশি। এভাবে আট দপ্তর থেকে নবায়ন করতে গিয়ে বছর শেষ হয়ে যায়। তখন আবার নতুন করে পরের বছরের জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে হয়।
ব্যবসা করতে হলে প্রথমেই ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। এ ছাড়া, আরও অন্তত সাত প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বা লাইসেন্স লাগে। আইনানুযায়ী আবেদন করার সাত কর্ম দিবসের মধ্যেই লাইসেন্স ও অনুমোদন দেওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। ঘুষ ছাড়া ট্রেড লাইসেন্স মেলে না। এটা ‘ওপেন সিক্রেট’ বিষয়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ টাকা না দিলে মাসের পর মাস পড়ে থাকে।
অথচ প্রতিবেশি ভারতসহ অনেক দেশ এক ধাপে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করে। বাংলাদেশে এখনও আট প্রতিষ্ঠানের অনুমতি লাগে।
বিশ্বব্যাংকের ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ শীর্ষক সর্বশেষ প্রতিবেদনে ব্যবসা সহজীকরণে সার্বিক বিবেচনায় অগ্রগতি বলা যায় না। বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখনো পেছনের দিকে।
এই অবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ভোগান্তি দূর করতে নতুন লাইসেন্স করার ক্ষেত্র সহজ করা, ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের মেয়াদ পাঁচ বছর করার জন্য ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি (এমসিসিআই) ট্রেড লাইসেন্সের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে লিখিত প্রস্তাব করে। একই সঙ্গে এর অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজ করারও দাবি তুলেন ব্যভসায়ীরা। বিষয়টি আমলে নিয়ে সরকারও লাইসেন্সের মেয়াদ পাঁচ বছর করার সিদ্ধান্ত নেয়।
তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করে গত ১৪ মার্চ বোর্ড সভায় ট্রেড লাইসেন্সের মেয়াদ বৃদ্ধির অনুমোদন দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ট্রেড লাইসেন্সের ব্যাপারে বলা হয়েছে-সিটি কর্পোরেশনের মতো পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্স এ মেয়াদ ৫ বছর করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক আইন ও বিধিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর আনা যেতে পারে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো রপ্তানিকারকের এনরোলমেন্ট এর মেয়াদ এক বছর থেকে তিন বছর করার অনুমোদন দিতে পারে। একইভাবে আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর ইমপোর্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (আইআরসি) ও এক্সপোর্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (ইআরসি) নিবন্ধনের মেয়াদ তিন বছর করার অনুরোধ করা হয়েছে।
যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমুহের পরিদপ্তর থেকে নামের ছাড়পত্র নিতে হয় ব্যবসায়ীদের। এজন্য অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া শেষ করতে হয়। ভোগান্তি কমাতে প্রয়োজনে আউটসোর্সিং করে বা কোনো প্রকল্পের আওতায় দ্রুত সব কাজ করতে বলা হয়ছে।
এর বাইরে পরিবেশ অধিদপ্তর সবুজ শ্রেণির ব্যবসায়ের জন্য তিন বছর ও অন্যান্য শ্রেণির জন্য এক বছর মেয়াদী ছাড়পত্র দেয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে যৌক্তিক ক্ষেত্রে শ্রেণি পরিবর্তন করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছে। একইভাবে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে লাইসেন্সের মেয়াদ তিন বছরের করার জন্য প্রয়োজনে বিধিমালা সংশোধন করতে বলা হয়েছে।
অগ্নি নিরাপত্তা লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকেও এক বছরের বদলে তিন বছর করার জন্য প্রথমে পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আমদানি রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্তদেরকে ৫ বছরের জন্য যে সিঅ্যান্ডএফ লাইসেন্স ও শিপিং এজেন্ট লাইসেন্স দিয়ে আসছে সেটা অব্যাহত রাখতে বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানিয়েছেন, বর্তমান সরকার ব্যবসাবান্ধব। তাই আমদানি-রপ্তানির জন্য বিভিন্ন সনদ দেওয়া ও নবায়নের বিষয়টি সহজ করা হয়েছে। আগে যেখানে এক বছর মেয়াদ ছিল সেটা পাঁচ বছর করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই এক সভায় বিভিন্ন সনদ নবায়নের সময় পাঁচ বছর করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এনএইচবি/এমএমএ/