বাজারে নৈরাজ্য থামছেই না
চাল, চিনি, ডাল, সয়াবিন তেলসহ নিত্যপণ্য যথেষ্ট মজুত থাকার পরও বাজারে চলছে অস্থিরতা। চাহিদা অনুযায়ী এসব পণ্যের আমদানি হচ্ছে নিয়মিত। তারপরও এসব নিত্যপণ্যের কোনোটিই সরকার নির্ধারিত মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু তেল, চাল, ডাল নয়, রমজানকে সামনে রেখে ছোলা, আদা, রসুনের দামও এখন ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। আর বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান নিজেদের নামে এসব পণ্য প্যাকেটজাত করে নিচ্ছে আরও বাড়তি দাম।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ার করার পরও নৈরাজ্য চলছে বাজারে। মিল থেকে শুরু করে পাইকারি, খুচরা ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে যে যার মতো ভোক্তাদের কাছে এসব পণ্য বিক্রি করছে।
এই পরিস্থিতিতে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর রবিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ও মুল্য পরিস্থিতি নিয়ে সভার আয়োজন করেছে। যেখানে ঢাকা মহানগর এলাকার সকল বাজার কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ খাত সংশ্লিষ্টদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। সভায় বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষও উপস্থিত থাকবেন।
আমদানি বেশি তবুও মিলছে না চিনি
বাংলাদেশ ব্যাংক, ট্যারিফ কমিশন ও টিসিবি সূত্র বলছে, দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। এর মধ্যে রমজানের চাহিদা ৩ লাখ টন। বাকি মাসগুলোতে গড় চাহিদা দেড় লাখ টন। দেশে উৎপাদন হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টন। তাই চাহিদা মেটাতে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করতে হয়। প্রতি মাসে এই চিনি আমদানি হচ্ছে। গত জানুয়ারি মাসেও ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে চাহিদার তুলানায় বেশি চিনি মজুত আছে।
রিফাইনারি মিল মালিকরা ডলারের সংকট দেখিয়ে কয়েক দফা চিনির দাম বাড়িয়েছে। এই চিনিতে বিভিন্ন পর্যায়ে সব মিলে ৬১ শতাংশ কর দিতে হয়। ডলার সংকটের অজুহাতে ব্যবসায়ীরা দাম বেশি করে বাড়াতে চাইলে এনবিআর চিনি আমদানিতে ১০ শতাংশ শুল্ক ছাড় দিয়েছে। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে সরকারের খাদ্য ও চিনি শিল্প করপোরেশন প্রতি কেজি খোলা চিনি ১০৭ টাকা ও প্যাকেট চিনি ১১২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। তারপরও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না চিনি।
সরেজমিনে গেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, টাউনহলসহ বিভিন্ন বাজারে গেলে খুচরা বিক্রেতা বলছেন, মিল থেকে চিনি না দেওয়ায় তারাও বিক্রি করতে পারছেন না। কোনো কোনো দোকানে চিনি পাওয়া গেলেও ১২০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। টিসিবির তথ্যও বলছে বাজারে ১১০ থেকে ১২০ টাকা দরে চিনি বিক্রি হচ্ছে।
ছোলার দামেও আগুন
রমজানকে সামনে রেখে ছোলার দাম বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। দেশে বছরে ছোলার চাহিদা মাত্র দেড় লাখ টন। রমজানে সেই চাহিদা কিছুটা বাড়ে। সেটি বিবেচনায় নিয়ে গত চার মাসে প্রায় দেড় লাখ টন ছোলা আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেকগুলো ছোলা দেশে চলেও এসেছে। তারপরও ছোলার দাম বাড়তির দিকে। এক বছরে ছোলার দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। আর গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজি প্রতি ১০ টাকা বেড়ে এখন ৯০ থেকে ৯৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
চালের বাজারে বড় কোম্পানির দস্যুতা
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, দেশে চালের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২ কোটি ২৭ লাখ টন। আর দেশে চালের উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ৪ লাখ টন। বতর্মানে দেশে চাল এবং ধানের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সরকারের গুদামে খাদ্যশস্য মজুদ প্রায় ২০ লাখ টন। তারপরও মোটা থেকে চিকন চালের দাম কমে না।
টিসিবি বলছে, বর্তমানে মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫২ টাকা কেজি, চিকন চাল ৭৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পর্যাপ্ত মজুত ও উৎপাদন ভালো হওয়ার পরও বছরের ব্যবধানে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৭ থেকে ১০ টাকা। নিয়ন্ত্রণহীন চালের বাজারের বড় দস্যু হচ্ছে প্রাণ, আকিজ, সিটি গ্রুপসহ বিভিন্ন কোম্পানি। যারা নিজেদের নামে চাল প্যাকেটজাত করে কেজিতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭টাকা বেশি নিচ্ছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম সম্প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চালের বাজারে পুরো প্রতারণা চলছে। তারা মোটা ধানকে তিনটা মেশিনে চিকন করে বেশি দামে বিক্রি করছে। স্বর্ণা ধানকে কেটেকুটে পুষ্পবতি চাল বলে বিক্রি করছে। এতে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। ভোক্তাদের খরচ বাড়ছে। তিনি বলেন, যে নামে ধান সেই নামে চাল বিক্রি করতে হবে। এজন্য বাজার ব্যবস্থাপনার সংস্কার দরকার। কারণ একদিকে চালের অপচয়, অন্যদিকে পুষ্টির মান কমছে, ভোক্তারা প্রতারণা শিকার হচ্ছে।
আটার বাজারও অস্থির
দেশে বার্ষিক গমের চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হচ্ছে ১২ লাখ টন। বাকি গম আমদানি করতে হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন গমের দাম ৩৬০ দশমিক ৮২ ডলার। তারপরও দেশের বাজারে আটার দাম কমছে না। সিটি গ্রুপ, এসিআই, বসুন্ধরাসহ বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানির ২ কেজির প্যাকেটজাত আটা ১৩০ টাকা ও খোলা আটা ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক বছর আগে প্রতি কেজি আটা ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি বিক্রি হতো। টিসিবিও বলছে, বছরের ব্যবধানে কেজিতে আটার দাম বেড়েছে ৫৬ থেকে ৬৬ টাকা। ময়দার দামও বছরের ব্যবধানে বেড়েছে কেজিতে ৩২ থেকে ৪১ টাকা। কারণ বর্তমানে প্রতি কেজি ময়দা ৬৮ থেকে ৭৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
ভোজ্যতেলর বাজারও নিয়ন্ত্রহীণ
সরকারের তথ্য অনুযায়ী,বছরে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২০ লাখ টন। এরমধ্যে দেশে সরিষার উৎপাদন হয় ২ লাখ টনের বেশি। বাকিটা আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। প্রতি মাসে গড়ে দেড় লাখ টন চাহিদা হলেও রমজানে চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ টন। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে প্রতি ব্যারল ১২১৯ ডলার। সেই তেল পরিশোধন করে মিলমালিকরা বোতলজাত করে ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা লিটার বিক্রি করছে। আর খোলা তেল বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ১৬৮ থেকে ১৭২ টাকা। পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা লিটার।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্বে তেলের দাম বাড়লে দেশের বাজারে দ্রুত দাম বেড়ে যায়। কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশের বাজারে দাম আর কমে না।
ডালেও বাড়তি দাম
রমজানকে সামনে রেখে দেশে ডালের চাহিদা বেড়েছে। এ কারণে ডালের আমদানিও বেড়েছে। একইসঙ্গে দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত মাসে চিকন ডাল ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও বর্তমানেখুচরা পর্যায়ে ১৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আর মোটা দানার মুশুর ডাল প্রতি কেজি ৯৫ থেকে ১০০ টাকা বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, আমাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে।
ট্যারিফ কমিশন বলছে, এক মাস আগে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন ডালের দাম ছিলো ৫১২ দশমিক ২২ ডলার। যা বর্তমানে কমে ৫০০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এক মাসের ব্যবধানে মূল্য কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ। তা ছাড়া, মসুর ডাল আমদানিতে কোনো শুল্ক লাগে না।
বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে আদা, রসুন
দেশের বাজারে আদা ও রসুনের দাম নিয়ে অস্থিরতা কাটছে না। দেশে রসুনের বার্ষিক চাহিদা সাড়ে ৬ লাখ টন। উৎপাদন হচ্ছে ৭ লাখ টনের বেশি। প্রতি কেজি ৭০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তারপরও কিছু আমদানি করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এই রসুনের টন ৪০৬ ডলার।
আমদানি করা এই রসুন দেশের বাজারে ১৮০ টাকা কেজি বিক্রি দরে। দেশে পর্যাপ্ত রসুন উৎপাদন হলেও ডলারের সংকটের অজুহাতে কোনো কোনো সপ্তাহে বিদেশি রসুন প্রতি কেজি ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে খুচরা বিক্রেতারা।
অপরদিকে, দেশে আদার চাহিদা ৩ লাখ টনের বেশি হলেও উৎপাদন হচ্ছে ২ লাখ টনের বেশি। দেশি আদা ১৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। রমজান মাসে আদার চাহিদা কিছুটা বেড়ে যায়। এই সুযোগে দামও বাড়িয়ে নেয় ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে দেশি আদা প্রতি কেজি ১৮০ টাকা এবং বিদেশি আদা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়।
এনএইচবি/এমএমএ/