ট্যাক্স ছাড়ে বাড়ছে না কর-জিডিপির অনুপাত
সরকার বড় বড় প্রকল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় মেটাতে প্রতি অর্থবছরে বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়াচ্ছে। এই রাজস্ব বাড়লেও কর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাত বাড়ছে না। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে (ট্যাক্স) রাজস্ব ও দেশীয় শিল্পের বিকাশে রাজস্ব ছাড় ও প্রণোদনা দেওয়ার কারণেই কর-জিডিপি বাড়ছে না। স্বল্পকর হার, কর অব্যাহতি ও কর অবকাশ সুবিধা দেওয়ার কারণে কর জিডিপির অনুপাত প্রকৃত অনুপাত থেকে ২ দশমিক ২৮ শতাংশ কম হচ্ছে। কিন্তু আইএমএফ বলছে ঋণ নিতে হলে তা বাড়াতে হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র মতে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯-১২ অর্থবছরে এক লাখ ১৩ হাজার টাকার বেশি বাজেট ঘোষণা করে। এতে এনবিআর এর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয় ৬১ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এভাবে প্রতি অর্থবছরে বাজেটের আকার বাড়তে বাড়তে গত অর্থবছরে (২০২১-২২) ৬ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে। যেখানে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে আদায় হয়েছে ৩ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ শতাংশের বেশি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর আদায় হয় মূলত ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) বা মূসক, আয়কর ও কাস্টমস থেকে।
এই তিন খাতের কর আহরণ ভালো হলেও সেই তুলনায় কর জিডিপির অনুপাত খুবই কম। তা কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। স্বল্পকর হার, কর অব্যাহতি ও কর অবকাশ সুবিধা দেওয়ার কারণে কর জিডিপির অনুপাত প্রকৃত অনুপাত থেকে ২ দশমিক ২৮ শতাংশ কম হচ্ছে। কিন্তু যে করেই হোক এটা বাড়াতে হবে। এই বাড়ানোসহ আর্থিকখাতে সংস্কারের শর্তে আইএমএফ সম্প্রতি ঋণ দিয়েছে।
এ ব্যাপারে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর গবেষণা পরিচালক ড. এম এ রাজ্জাক বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের টাকা পেতে সরকারকে ২০২৬ অর্থবছর শেষে অতিরিক্ত ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে হবে। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব খাতকে শক্তিশালী করতে আইএমএফ এ শর্ত দিয়েছে। তিনি বলেন, আইএমএফের ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে শর্ত অনুযায়ী জিডিপিতে করের অবদান সাত দশমিক ৮ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৮.৮ শতাংশ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরের কর জিডিপি অনুপাত বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।
এনবিআর সূত্র বলছে, শিল্পখাতের পণ্য পরিবহন ও সরবরাহসহ অবকাঠামো খাতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে ২২টি তথ্য প্রযুক্তিখাতে ২০০৮ সাল থেকে শতভাগ কর অব্যাহতি রয়েছে। রপ্তানিমুখী পোশাক ও বস্ত্র খাতেও ১২ শতাংশ কর সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া দেশীয় শিল্পের বিকাশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত পণ্য বিক্রি ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সম্পূর্ণ করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
কৃষিখাত, ফল ও শাক-সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের শিল্প থেকে আয়ের উপর ৫ থেকে ৭ বছরের জন্য ১০০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক ও পিপিপি প্রকল্পেও বিশেষ কর অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতেও কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ করোনাকালেও স্বাস্থ্যখাতের সুরক্ষা দিতে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে।
১৯৭২ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গঠনের পর ব্যক্তি শ্রেণির কাছে কর আদায় করা হয়। এরপর সময়ের পরিবর্তনে ১৯৮৪ সালে আয়কর আইন, ১৯৯৩ সালে করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) প্রচলন হয়। তারপর থেকেই প্রত্যেক ব্যক্তির আয়ের উপর কর ধার্য করা হয়। একে আরও গ্রহণযোগ্য করতে ২০০৯ সালে জাতীয় আয়কর দিবস ও ২০১০ সাল থেকে আয়কর মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। এরপর আয়করকে আরও সহজলভ্য করার জন্য ই-টিআইএন ও ই রিটার্ন দাখিল ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়।
এনবিআর সূত্রে আরও জানা গেছে, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মোট রাজস্ব আদায়ে আয়কর (প্রত্যক্ষ কর) আদায় হয়েছিল প্রায় ১১ কোটি টাকা বা ১০ শতাংশের কম। গত অর্থবছরে এসে আয়কর আদায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা বা ৩৪ শতাংশ। ২ লাখ ৮৫ হাজার রিটার্ন দাখিলের মাধ্যমে এই আয়কর আদায় হয়েছে। তারপরও কর জিডিপির অনুপাত কম।
এ ব্যাপারে এনবিআর এর কমিশনার সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, আমরা আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস এর মাধ্যমে রাজস্বের ৯৬ শতাংশ আহরণ করি। বাকি ৪ শতাংশ সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে বাজেটের রাজস্ব আদায় করে। ভ্যাট বেশি করে আদায় করার জন্য ১৯৯১ সালে প্রথম ভ্যাট প্রথা চালু করা হয়। এরপর ২০১২ সালে ভ্যাট আইন হলেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে ৭ বছর পর ২০১৯ সালে তা কার্যকর হয়। কিন্তু সরকার যে উন্নয়ন কৌশল অবলম্বন করেছে অর্থাৎ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে যেতে রাজস্ব আরও বাড়াতে হবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কর জিডিপির অনুপাত ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। বর্তমানে ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে। আমরা এভাবে আয় করলেও মাত্র দশমিক ২২ শতাংশ বিনিয়োগ করা হয় অর্থাৎ ১০০ টাকা আয় করলে ২২ পয়সা ব্যয় করা হয়। তাই রাজস্ব আহরণে পদ্ধতিগত সংস্কার দরকার, সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে হবে।
এদিকে এনবিআর এর আরেক সদস্য শওকত আলী সাদিক বলেন, আমাদের স্মার্ট ভ্যাট ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। করের আওতা বাড়ানোর জন্য ই-রিটার্ন দাখিল, ইএফডি মেশিন চালুসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গুগল, অ্যামাজনসহ অনেক কোম্পানিকে করের আওতায় আনা হয়েছে।
আরেক কর কমিশনার ইকবাল হোসেন বলেন, অর্থনীতির চাহিদা বিবেচনা করে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট ও দেশীয় শিল্পের বিকাশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর ছাড় ও প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে এ কারণে ২ দশমিক ২৮ শতাংশ কম হচ্ছে কর-জিডিপির অনুপাত। তাই কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ছে না। তারপরও আমরা প্রত্যক্ষ করে গুরুত্ব দিচ্ছি। জানুয়ারি পর্যন্ত ৮৪ লাখ ৪৯ হাজার করদাতা নিবন্ধিত হয়েছে। আর রিটার্ন দাখিল হয়েছে ২ লাখ ৮৫ হাজার। ২০১৫ সালে করদাতা নিবন্ধিত ছিল মাত্র ১৬ লাখ ৫১ হাজার এবং রিটার্ন দাখিল করেছিল এক লাখ ৯২ হাজার।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সদ্য শেষ হওয়া রাজস্ব সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন, আমরা ট্যাক্স বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। জমি রেজিস্ট্রেশনসহ ৩৮টি জায়গায় রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ডিপিডিসির সঙ্গেও চুক্তি হয়েছে। বিদ্যুৎ বিল ও জমির দলিল দেখে করদাতা শনাক্ত করা হচ্ছে। তবে সব কিছু অটোমেশন করা হলেই যে ফল ভালো পাওয়া যাবে তা না। কারণ সফটওয়্যার রান করার জন্য দক্ষ মানুষ নেই। তা একান্ত দরকার।
এনএইচবি/আরএ/