বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনে সুফল পাবে বাংলাদেশ
মহামারি করোনাভাইরাসের ছোবল এবং পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলো এখন আর এককভাবে চীনের উপর নির্ভর থাকতে চাইছে না। আমদানির উৎস বাড়ানোর চেষ্টায় তারা এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে নজর দিচ্ছে। এতে বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দেশ লাভবান হতে পারে বলে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সেন্টার ফর দ্য নিউ ইকোনমি অ্যান্ড সোসাইটির এক জরিপে উঠে এসেছে।
দাভোসে চলমান সংস্থার বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে গত সোমবার প্রকাশিত ওই জরিপ প্রতিবেদনে বিশ্বের শীর্ষ ২২ অর্থনীতিবিদ মতামত দিয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিনিয়োগ ব্যাংক ও বহুজাতিক সংস্থার অর্থনীতিবিদরা।
জরিপে দুই-তৃতীয়াংশ শীর্ষ অর্থনীতিবিদ জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে বিশ্ব মন্দায় পড়তে পারে। এর মধ্যে ১৮ শতাংশ মনে করছেন, মন্দা তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। সার্বিক মন্দার বিষয়ে অর্থনীতিবিদের মধ্যে এক ধরনের মতৈক্য আছে। তবে তীব্র মন্দার আশঙ্কা অনেকটাই কমেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত সংস্থার জরিপে ৩৫ শতাংশের বেশি অর্থনীতিবিদ জানান, তীব্র মন্দার আশঙ্কা আছে। অর্থাৎ নানা পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে অনেক অর্থনীতিবিদ মত বদলেছেন। যদিও এখনো এক-তৃতীয়াংশ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এ বছর মন্দা হবে না।
তবে মন্দার বিষয়ে এ বছর এরই মধ্যে সতর্ক করেছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক। আইএমএফপ্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেছেন, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ দেশ এ বছর মন্দায় পড়বে। আর বিশ্ব অর্থনীতি ‘বিপজ্জনকভাবে মন্দার কাছাকাছি’ বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে বিশ্বব্যাংক।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ২০২৩ সালের এই জরিপে দুই অঞ্চলকে প্রবৃদ্ধিতে শক্তিশালী উল্লেখ করা হয়েছে। একটি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা (এমইএনএ) এবং অন্যটি দক্ষিণ এশিয়া। দক্ষিণ এশিয়ায় ভালো প্রবৃদ্ধি আশা করছেন ৮৫ শতাংশ অর্থনীতিবিদ। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ মধ্যম মানের ও ১৫ শতাংশ শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি আশা করছেন। তাদের মতে, বাংলাদেশ, ভারতসহ কিছু অর্থনৈতিক দেশ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পটপরিবর্তনে সুবিধা পাবে। ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের সরবরাহব্যবস্থা চীনের পাশাপাশি অন্যান্য দেশেও বাড়াচ্ছে। এই বৈচিত্র্যায়ণের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলো লাভবান হতে পারে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে আসবে। গত বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় যেভাবে বিশ্বের প্রায় সব কেন্দ্রীয় ব্যাংক একযোগে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে, তাতে অর্থের প্রবাহ কমেছে। স্বাভাবিকভাবেই কমেছে চাহিদা। সেই সঙ্গে সরবরাহব্যবস্থাও স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তবে সব অঞ্চলের মূল্যস্ফীতির হার এক হবে না। ইউরোপের ক্ষেত্রে ৫৭ শতাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা আছে। অথচ চীনের ক্ষেত্রে মাত্র ৫ শতাংশ অর্থনীতিবিদ তা মনে করেন। আইএমএফ মনে করছে, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নেমে আসবে, ২০২২ সালে যা ছিল ৮.৮ শতাংশ।
সব অর্থনীতিবিদ আশা করছেন, ২০২৩ সালে ইউরোপের অর্থনীতি দুর্বল বা খুবই দুর্বল হবে। যদিও ৯১ শতাংশ মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধিও দুর্বল বা খুবই দুর্বল হবে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির পরিস্থিতি নিয়ে অর্থনীতিবিদরা একমত হলেও চীনের বিষয়ে তারা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। কেউ মনে করেন, এ বছর চীনও মন্দার কবলে পড়বে। আবার অন্যরা মনে করছেন, দেশটির প্রবৃদ্ধি হবে।
গত সোমবার বৈশ্বিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্সের (পিডাব্লিউসি) জরিপে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্বের ৪০ শতাংশ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। তারা মনে করছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য বর্তমানে যে ধারায় চলছে, সেভাবে চলতে থাকলে আগামী এক দশকের মধ্যে তাদের কোম্পানি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক অবস্থায় থাকবে না। প্রায় সব খাতের প্রধান নির্বাহীরাই এমনটি বলেছেন। যেমন টেলিযোগাযোগ খাতের ৪৬ শতাংশ, উৎপাদনশীল খাতের ৪৩, স্বাস্থ্যসেবা খাতের ৪২ ও প্রযুক্তি খাতের ৪১ শতাংশ প্রধান নির্বাহী এমন শঙ্কা জানিয়েছেন।
এ জরিপে ৭৩ শতাংশ সিইও মনে করছেন, চলতি বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার কমবে। এ ছাড়া কম্পানির ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি নিয়েও প্রধান নির্বাহীদের আত্মবিশ্বাস আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। বর্তমানে তাদের আত্মবিশ্বাস হ্রাসের হার ২৬ শতাংশ। এর আগে ২০০৮-০৯ সালে বৈশ্বিক মন্দার সময়ের আত্মবিশ্বাস হ্রাসের হার ছিল সর্বোচ্চ ৫৮ শতাংশ। বর্তমানের ব্যবসা-বাণিজ্যের আশঙ্কাজনক বাস্তবতায় প্রধান নির্বাহীরা খরচ কমাতে শুরু করেছেন। তবে উন্নত বিশ্বে যেভাবে মানুষ চাকরি ছাড়ছেন, তাতে মেধাবী কর্মীদের ধরে রাখতে ৬০ শতাংশ প্রধান নির্বাহীর বেতন কমানোর পরিকল্পনা নেই। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চার হাজার ৪১০ জন সিইও এই জরিপে অংশ নিয়েছেন।
আরএ/