বছরজুড়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোলে চাল, সয়াবিন তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে চলতি বছরে। ডলার সংকটের অজুহাতে ভোক্তাদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো দাম আদায় করেছেন ব্যবসায়ীরা। এটা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে ধরাও পড়েছে। ভোক্তা অধিদপ্তর বিভিন্ন কোম্পানিকে জরিমানা করছে। বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার, প্রাণ, মেঘনা, আকিজ, বব্যুকক, স্কয়ারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৪৪টি মামলা করেছে। শুনানিতে তাদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে বিদায়ী বছরে। তারপরও আগের দামের পণ্য শেষ না হতেই বেশি দামের পণ্য বাজারে বিক্রি করছে বিভিন্ন কোম্পানি।
বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে সরকার মূল্যস্ফীতি কমিয়ে জনগণকে একটু স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে। বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রে যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভারে সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে। আমদানি ব্যয় ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে। তারপ্রভাবে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
তেল নিয়ে তেলেসমাতি
সরকার রমজান মাস উপলক্ষে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপর আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহার করে। সয়াবিন তেলের আমদানির উপর ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ মওকুফ করা হয়েছে। সয়াবিন তেলের দাম গত মার্চ মাস থেকে একেবারে নিয়ন্ত্রীণ হয়ে পড়ে। গত রমজানে সয়াবিন তেল নিয়ে শুরু হয় হই হই কাণ্ড। ভোজ্যতেল প্রতি লিটার ১৫০ টাকা এবং পাঁচ লিটার ৭০০ টাকা বিক্রি করা হলেও মিল মালিকরা বলতে থাকে তেল আছে, আর ব্যবসায়ীরা বলে পাওয়া যাচ্ছে না। জটিল গোলক ধাঁধায় ভোক্তা অধিদপ্তর বাধ্য হয়ে মিলে মিলে অভিযানে নামে।
দেশে বছরে ২০ লাখ টন সয়াবিন তেল লাগে। মাসে লাগে ১ লাখ ২০ হাজার টন। তবে রমজানে আড়াই লাখ টন লাগে। প্রতি মাসে বিভিন্ন কোম্পানি এর চেয়ে বেশি তেল দিচ্ছে। তারপরও বাজারে সংকট দেখা দেয়। কেউ কেউ দোকানের নিচে লুকিয়ে রাখে। শুধু তাই নয়, ক্রেতারা সয়াবিন তেল কিনতে গেলে মালিকরা ধরিয়ে দেয় সরিষার তেল। মার্চে পাঁচ লিটার তেল ৭২০ টাকা মূল্য থাকলেও ক্রেতারা তা সহজে পাননি। এরপর থেকেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে তেলের দাম। এভাবে তেল নিয়ে অনিয়ম ধরা পড়ায় এস আলম এডিবল অয়েল মিল, টি কে গ্রুপ, ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল (রূপচাঁদা ব্র্যান্ড) কারখানার চেয়ারম্যান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ৩০ মার্চ তলব করে ভোক্তা অধিদপ্তর।
এরপর ঈদের পর ৫ মে এক লাফে তেলের দাম লিটারে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ১৯৮ টাকা। তাতেও তেল নিয়ে হই-চই চলতে থাকায় গত ৯ জুন বাজেট ঘোষণার দিন সর্বশেষ তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারে ৭ টাকিা। বোতলজাত তেলের দাম ঠিক করা হয় ২০৫ টাকা লিটার। খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৮৫ টাকা লিটার। এক লাফে গত ৫ মে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৩৮ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এর আড়াই মাস পর ১৪ টাকা কমানো হয়। এরপর ১৯২ থেকে কমিয়ে সর্বশেষ ১৮ ডিসেম্বর সরকার তেলের দাম ১৮৭ টাকা লিটার ঘোষণা করেছে আর পামওয়েল ১১৭ টাকা লিটার। তারপরও সেই দামে পাওয়া যাচ্ছে না তেল।
চিনি নিয়ে ছিনিমিনি
বছরের প্রথমে জানুয়ারি মাসে সারাদেশে ৬৫ টাকা কেজি চিনি বিক্রি করা হয়। তবে দাম বাড়তে থাকে বছরের শেষ দিকে। যত দিন যাচ্ছে ডলারের সংকট দেখিয়ে মিলমালিকরা বাড়াতেই আছে দাম। মার্চে চিনি ৮৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হলেও গ্যাস সংকটের অজুহাতে দাম বাড়তে থাকে। অক্টোবর মাসে চিনি রিফাইনারি মিলমালিক ও সরকার প্রতি কেজি খোলা চিনি ৯০ টাকা ও প্যাকেটজাত ৯৫ টাকা কেজি বিক্রির ঘোষণা দেয়। তারপর বাজার থেকেই উধাও হয় চিনি। মিলমালিকদের চাপে বাধ্য হয়ে সরকার খোলা চিনি ১০২ টাকা ও প্যাকেট চিনির কেজি ১০৮ টাকা ঘোষণা করে। তবে সেই দামে বাজারে মিলছে না চিনি।
আটার দাম নিয়ে আট মামলা
মার্চে দুই কেজি আটা ৮২ টাকা থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হলেও দিন বদলের পালায় দামও বাড়ছে হুহু করে। বর্তমানে বসুন্ধরা, তীরসহ বিভিন্ন কোম্পানির ২ কেজির আটা ১৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। এদিকে আটা-ময়দা বেশি দামে বিক্রির অভিযোগে মেঘনা গ্রুপ, আকিজ, বসুন্ধরা, এসিআই, টিকে গ্রুপ, নুরজাহান গ্রুপ, এস আলম ও সিটি গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন।
চাল মিলমালিকদের বিরুদ্ধে ১৯ মামলা
জানুয়ারিতে আমন ধান উঠার পরও কমেনি চালের দাম। শুল্ক কমানোর পর বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে শর্ত সাপেক্ষে চাল আমদানির অনুমোদন দেয় সরকার। এরপর চালের দাম বেশি রাখার অভিযোগে গত সেপ্টেম্বরে কুষ্টিয়ার রশিদ অ্যাগ্রো ফুড প্রডাক্ট লিমিটেড, দাদা রাইস মিল, নওগাঁর বেলকন গ্রুপ, মফিজউদ্দিন অটো রাইস মিল, মজুমদার রাইস মিল ও ম্যাবকো হাইটেক রাইস মিলের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। দিনাজপুরের জহুরা অটো রাইস মিল, চাঁপাই নবাবগঞ্জের এরফান গ্রুপ, বগুড়ার কিবরিয়া এগ্রো, আলাল এগ্রো ফুড, খান অটো রাইস মিলের বিরুদ্ধে মামরা করা হয়। এ ছাড়া করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের নুরহাজান এগ্রো ফুড লিমিটেড, মহাখালীর স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, তেজগাঁয়ের এসিআই লিমিটেড, ব্র্যাক সিড অ্যান্ড এগ্রো লিমিটেড, গুলশানের বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড ও সিটি গ্রুপ, মধ্যবাড্ডার প্রাণ ফুডস লিমিটেড ও নারায়ণগঞ্জের সিটি অটো রাইস মিলও রয়েছে মামলার তালিকায়।
এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথা বললে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে। বাধ্য হয়ে ভোক্তা অধিদপ্তর সারা দেশে বাজারে অভিযান পরিচালনা করে। বিভিন্ন খাতের উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে ভোক্তা অধিদপ্তর। সঠিক জবাব না পেয়ে বেশি দাম রাখায় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন সেপ্টেম্বর মাসে প্রাণ, ব্রাক, সিটি, স্কোয়ার, রশিদ, এরফান গ্রুপ, তেল কোম্পানি এডিবল ওয়েল কোম্পানিসহ ১৯টি নামিদামি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বেশি দামে চাল বিক্রি করায় মামলা করেছে। তাদের যথযথ কারণ উল্লেখ করে গত ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে।
বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা
অধিকাংশ পণ্যের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোয় ৭ সেপ্টেম্বর বেশ কয়েকটি বহুজাতিত কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে তলব করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এমনকি ইউনিলিভার দুই তিন মাসে চার থেকে পাঁচ বার পণ্যের দাম বৃদ্ধি করেছে বলে অভিযোগ খুচরা বিক্রেতা ও ভোক্তাদের। এসব অভিযোগে সাবান, পাউডার বেশি দামে বিক্রি করার অভিযোগে ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড, স্কয়ার গ্রুপ, কোহিনুরি কেমিক্যাল ও কেয়া গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও মামলা করে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন।
ডিম ও মুরগির ১২ মামলা
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে আড়ৎদার পর্যন্ত বেশি দামে ডিম ও মুরগি বেশি দামে বিক্রির অভিযোগেও মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। ডিম বেশি দামে বিক্রির কারণে গাজিপুরের সিপি বাংলাদেশ লিমিটেড, মহাখালীর প্যারাগন পোল্ট্রি, বসুন্ধরার ডায়মন্ড এগ, মগবাজারের পিপলস ফিড, ধানমন্ডীর কাজী ফার্মস গ্রুপ এবং তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী আড়ৎদার বহুমুখী সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়া মুরগি বেশি দামে বিক্রি করার জন্য কাজী ফার্মস, সিপি, প্যারাগন, নারিশ পোল্ট্রি, আলাল পোল্ট্রি ও সাগুনা ফুড অ্যান্ড ফিডসের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এসব মামলা এখনো চলছে।
কম দামে টিসিবির পণ্য
অপরদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম শুরু করে ২০ মার্চ থেকে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের বাইরে সারা দেশে একযোগে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে একসঙ্গে দুই লিটার ভোজ্যতেল, দুই কেজি চিনি, দুই কেজি ছোলা, দুই কেজি মসুর ডাল ও পাঁচ কেজি পেঁয়াজের প্যাকেট দেওয়া হচ্ছে। প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১১০ টাকা, প্রতি কেজি চিনি ৫৫ টাকা, মসুর ডাল ৬৫ টাকা, পেঁয়াজ ৩০ টাকা দরে বিক্রি করছে টিসিবি।
এসএন