সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ: সিপিডি
করোনার ধকল সামলে না উঠেতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট এখন আর স্বল্পমেয়াদি নয় উল্লেখ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, এই সংকট মধ্যমেয়ািদ থেকে দীর্ঘমেয়াদি হত পারে।
তিনি বলেন, ‘স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ নিয়ে এই সমস্যা সমাধান হবে না। দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, রপ্তানি ছাড়া সব ক্ষেত্রে চাপ রয়েছে। রিজার্ভ অনেক কমে গেছে।’
রবিবার (২৪ জুলাই) ধানমন্ডিতে সিপিডি অফিসের সম্মেলন কক্ষে ‘সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জঃ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় এসব কথা বলেন তিনি।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতি শক্তিশালীকরণে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, রাজস্ব আহরণ, ঋণখেলাপি, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তার বৃদ্ধির দিকে আরও নজর দিতে হবে সরকারকে।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক চাপ দেখা দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আমদানি ব্যয় মেটাতে ৪ মাসের পর্যায়ে নেমে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমদানি ব্যয় মেটাতে মুদ্রার সরবরাহ শৃঙ্খলায় বাধা সৃষ্টি হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও অনেক চাপ দেখা দিয়েছে। আটা-ময়দার দাম ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে এক বছরের ব্যবধানে।’
‘ডালে ৪০ শতাংশ, সয়াবিন তেলে ৩১ শতাংশ ও ডিমের হালিতে বেড়েছে ২৩ শতাংশ বেড়েছে। এরফলে মূল্যস্ফীতি সাড়ে সাত শতাংশ ছাড়িয়েছে। প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। সম্প্রতি আইএমএফ বলেছে, ২০২৩ সালেও অর্থনৈতিক সংকট থাকতে পারে। শ্রীলঙ্কার অবস্থা বেশি খারাপ হয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান কিছুটা ভালো হলেও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে।’
ফাহমিদা বলেন, ‘করোনায় দরিদ্ররা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই তাদের সহায়তা দিতে হবে। রপ্তানির তুলনায় আমদানি অনেক বেড়েছে। এ জন্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। নিত্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ কমে ৩৯ বিলিয়নে নেমে গেছে। যা দিয়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। তাই যে করে হোক রিজার্ভ বাড়াতে হবে। এ জন্য রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের দিকে নজর দিতে হবে।’
আলোচনা সভায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির যে অবস্থা তাতে বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তাই বর্তমান অবস্থায় ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। সুখে নেই। অস্বস্তিতে রয়েছে। দোকান, খাবার দোকানের বেচা-বিক্রি কমে গেছে। সংকটকালীন সময় মেনে নেওয়া হয়েছে। তবে বিদ্যুতে সাশ্রয়ী হতে উৎপাদন যাতে কোনোক্রমেই বিঘ্ন না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, এটা হলে রপ্তানি কমে যাবে। এর ফলে ডলারের মূল্য কমতে শুরু করবে।’
তিনি আরও বলেন, সরকার যেই মাত্র লোডশেডিং শুরু করেছে অনেকে চার্জার লাইট ও ফ্যানের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ২ থেকে ৩ শতাংশ ব্যবসায়ীরা এভাবে লাভের জন্য বিক্রি করছে। আমরা তাদের সমর্থন করি না।’
বুয়েটের অধ্যাপক ম তামিম বলেন, ২০০৭ সালের দিকে দ্রুত বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৩ থেকে ৫ বছরে সীমাবন্ধ রাখার কথা ছিলো কিন্তু ১২ বছর পরও বর্তমানে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের জন্য বড় সমস্যা। তাই বিশ্ব সংকটের প্রভাব পড়েছে। এটা বড় সমস্যা। বিদেশি বিনিয়োগ আনা হয়নি। এটা বড় ঝুঁকিতে পড়েছে দেশ। আবার ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থা্পনও ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ, জ্বালানির দাম বেশি। এতবেশি দাম বাড়বে কেউ কখনো কল্পনা করতে পারেনি। তাই গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে যেতে পরিকল্পনা করে চিন্তা করতে হবে। আমদানিকৃত কয়লা থেকে সরে আসতে হবে।’
সভায় সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাণিজ্যের নামে ৮০ শতাংশ ওভারভয়েসিং-ইনভয়েসিং হয়ে টাকা পাচার হচ্ছে। গত ১০ বছরে ৬০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এই অর্থ পাচারের পথ বন্ধ করতে হবে। আন্ডারভয়েসিং, ওভারভয়েসিং এর নামে জিরো টলারেন্স অবলম্বন করতে হবে।’
অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘আমদানি ব্যয় মেটাতে ডলারের দাম বাড়াতে হচ্ছে। যা আগে করা হয়নি। টাকার মান আগে অবমূল্যায়ন করা না হলেও সম্প্রতি তা ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ২০ শতাংশ অবমূল্যায়ন করা হলে বাজারে ৩৩ শতাংশ পণ্যের উপর প্রভাব পড়বে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে রিজার্ভেও প্রভাব পড়েছে। আগের চেয়ে তা কমে যাচ্ছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাচ্ছে। তাই আমদানি থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়ে নজরদারি খরবদারিতে নজর দিতে হবে।’
পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে স্বার্থের দ্বন্দ্বভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে। লৌহ ত্রিভুজ মাত্রিক উন্নয়ন দর্শনে আটকে গেছে দেশ। সার্বিক প্রেক্ষিতে সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। তিনটা অবিচার দেখা দিয়েছে। করোনার পরে নতুনভাবে দারিদ্র বেড়ে গেছে। এসডিজি অর্জনে পুষ্টির ঘাটতি, যা দুঃচিন্তার বিষয় হচ্ছে ও শিক্ষা ক্ষেত্রে ড্রফ আউট। এই তিন খাতে সুস্পষ্ট অবিচারের চেহারা দেখা দিয়েছে।’
জেডএ/এমএমএ/