ডলার বাজারের অস্থিরতার শেষ কোথায়?
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রায় সাত বিলিয়ন (৭০০ কোটি) ডলার বিক্রি করেছে। চলতি সপ্তাহেও বিক্রি করেছে প্রায় ৫৭ কোটি ডলার। তারপরও কোনোক্রমেই ঠেকানো যাচ্ছে না টাকার মান। যতই দিন যাচ্ছে ডলারের দাম বাড়ছে। গত দুই মাসের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে ৬ টাকা ৬০ পয়সা। বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৩ এপ্রিল ডলার বিক্রি করেছিল ৮৬ টাকা ২০ পয়সা দরে। সেই ডলার বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) বিক্রি করেছে ৯২ টাকা ৮০ পয়সায়।
ডলারের বাজারের এই অস্থিরতার শেষ কোথায় কারো জানা নেই। সম্প্রতি সব ব্যাংকের জন্য এক রেট করে দিলেও ডলারের বাজারে অস্থিরতা কাটেনি। বরং প্রতিনিয়ত পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডলারের দাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিক্রি করা ডলার ইউসিবিএল, ইবিএলসহ বিভিন্ন ব্যাংক ৯৬ টাকা দরে বিক্রি করছে। খোলা বাজারে (কার্ব মার্কেট) বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি দরে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি-রপ্তানির ঘাটতি কমলে স্থির হবে ডলারের বাজার। আর দেশে উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি কমিয়ে আনতে পারলেই কমবে ডলারের দাম।
ডলারের বাজারের এই অস্থিরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন দিক বিবেচনা করেই বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে থাকে। ডলারের সংকট মেটাতে বিলাসী পণ্যের লাগাম টানতে বেশি করে ট্যাক্স আরোপ, বিদেশ ভ্রমনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তারপরও রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের চেয়ে আমদানি বেশি হচ্ছে। এজন্য ডলারের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। তাই সরকার এবার দেশের মঙ্গল ও উন্নয়নে বিদেশ থেকে অর্থ ফেরতের উদ্যোগ নিয়েছে। এটা ইতিবাচক দিক। এতে দেশে ডলার আসবে। সংকটও কমবে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কালো টাকারও (ব্ল্যাক মানি) একটা ধরন আছে। যার আদৌ কোনো ভিত্তি নেই, সেটা এক রকম। আবার আন ডিক্লারড (যে কোনো কারণে অঘোষিত) রয়ে গেছে, সেটার ধরন অন্য রকম। রিটার্নে উল্লেখ করা হয়নি। সেটা নিয়ম মেনে দেশে আনা হলে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগবে।’
টাকার অবমূল্যায়ন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ মুখপাত্র বলেন, ‘পৃথিবীতে শুরু আছে, শেষ বলে কথা নেই। এটা কঠিন কথা, আগামীকাল কি হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতেও শেষ বলে কোনো কথা নেই। ডিমান্ড ও সাপ্লাইর উপর বাজার নির্ভর করে। তবে যেভাবে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে তার সুফল আশা করি পাওয়া যাবে। একটা পর্যায়ে হয়ত এই অবস্থায় স্থির হতে পারে। কারণ রপ্তানি আয় বাড়ছে, প্রবাসী আয়ও বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে আমদানির কাছাকাছি চলে আসলে বাজার স্থির হতে পারে। এখন যে পর্যায়ে রয়েছে সেটা অস্বাভাবিক বলে কিছু নয়। কারণ ভারতে ১১ শতাংশ, পাকিস্তানে ২০ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। আমাদের বেড়ে ৯২ টাকা পার হয়েছে। সার্কভূক্ত দেশের যে অবস্থা তাতে আমাদের এটা যে অস্বাভাবিক তা নয়। এটা ঠিক আছে।
আমদানি ব্যয় কিভাবে কমানো সম্ভব, বাংলাদেশ ব্যাংক এ বছরে কী পরিমাণ ডলার বিক্রি করেছে? এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমদানি বেশি হচ্ছে তাই দেশের উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি কমাতে হবে। সাত দিনে ৫৬৮ মিলিয়ন, এ পর্যন্ত সাত বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে কাজ না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গত ২৬ মে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সঙ্গে সভা করে ডলারের বাজার উন্মক্ত করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে অনেকে আপত্তি করে। আবার বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। চাহিদা বেশি থাকায় টাকা অবমূল্যায়ন করতে হচ্ছে।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনা প্রভাব, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, সারাবিশ্বে তেলের দাম বেড়েছে। করোনায় দুই বছর অনেক এলসির বিল পরিশোধ করা হয়নি। বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দামও বেড়ে গেছে। মানুষ হজে যাচ্ছে। চিকিৎসা নিতে বিদেশ যাচ্ছে। সবমিলে আমদানি বাড়ছে। তা ৮০ বিলিয়র ডলার হবে। আর রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও এফডিআই মিলে ৬০ বিলিয়ন ডলার হবে। ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ২০ বিলিয়ন ডলার। এই ঘাটতি কমার কারণেই ডলারের চাহিদা বাড়ছে।’
গত আগষ্ট মাসে রিজার্ভ ছিলো ৪৬ বিলিয়ন ডলার। তা থেকে প্রতি মাসে ডলার বিক্রি করায় বর্তমানে ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। ব্যাংকাররা বলছেন, এতে ভয়ের কিছু নেই। সাধারণত প্রতি মাসে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হয়। সে হিসেবে ১০ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে।
এনএইচবি/এমএমএ/