নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার দায় নিচ্ছে না কেউ
গত কয়েকদিনে খুচরা বাজারে চালের দাম প্রকারভেদে কেজিতে বেড়েছে আট থেকে দশ টাকা। আটার দাম বেড়েছে ১৫ টাকা। চিনির দামও বেড়েছে কেজিতে কমপক্ষে পাঁচ টাকা।
ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াসহ নানান অজুহাতে বাজারে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলছে। কিন্তু দাম বাড়ার এই দায় খুচরা, পাইকারি ব্যবসায়ী এমনকি মিলমালিক কেউই নিচ্ছে না। বরং একে অপরকে দোষারোপ করছেন। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, আপাত বাজেট ঘোষণার আগে কোনো জিনিসের দাম বাড়ছে না।
মঙ্গলবার (৭ জুন) সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে কথা হয় সিটি এন্টারপ্রাইজের আবু তাহেরের সঙ্গে। তিনি ঢাকাপ্রকাশে-কে বলেন, ‘দেখেন আমরা কোম্পানি থেকে মাল নিয়ে সামান্য লাভে বিক্রি করি। তারা দাম বেশি রাখলে আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘আগে ২ কেজি প্যাকেট আটার এমআরপি ছিল ৯০ টাকা। সেই আটা ১১০ থেকে ১১৫ টাকা করেছে তীর, এসিআই কোম্পানি। আমাদের সেই দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। একইভাবে ১৮০০ টাকার ময়দার বস্তা হয়েছে ২২০০ টাকা। তাই বাড়তি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। চিনি আগে ৬৮ টাকা কেজি কিনে ৭০ টাকা বিক্রি করতাম। তা বেড়ে বর্তমানে ৭৮ টাকায় কিনে ৮০ টাকা কেজি বিক্রি করছি। এভাবে সব জিনিসের দাম বাড়িয়েছে কোম্পানি। তাহলে আমাদের দোষ কোথায়? চালের ক্ষেত্রেও একই দশা। ২৪০০ টাকার বস্তা ৩৩০০ টাকা করে দিয়েছে মিলমালিকরা। আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
সরকার কী পদক্ষেপ নিলে কমবে দাম? এমন প্রশ্নের উত্তরে আবু তাহের বলেন, ‘যে যায় বলুক, সরবরাহ বাড়ালে পণ্যের দাম কমে যাবে। কারণ বাজারে পণ্যের সরবরাহ কম শুনা মাত্র ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তখনই দাম বাড়তে শুরু করে। কোম্পানির লোকেরা বলতে থাকে মাল কম, নেই, এমন কথা শুনা মাত্র ডিলাররাও দাম বাড়াতে থাকে। এরপর পাইকারি বাজারেও বাড়তে শুরু করে। খুচরা ব্যবসায়ীরাও সুযোগ নেয়। সাপ্লাই-চেইন ভেঙে পড়ে। এভাবে ভোক্তাদের পকেট কাটে।
কৃষি মার্কেটের সাপলা রাইস এজেন্সির শিপনেরও একই অভিযোগ। এই চালের আড়তদার বলেন, ‘আমরা কমিশনে চাল বিক্রি করি। কিন্তু কিছুদিন থেকে মিলমালিকরা সরকারকে চাল দেওয়ায় কথা বলে আমাদের চাল দিচ্ছে না। তাই দোকানে মাল কমে গেছে।
তিনি বলেন, ‘পাইকারি পর্যায়ে মিনিকেট ৬৪ থেকে ৬৮ টাকা কেজি, ২৮ চাল ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা ও মোটা চাল ৪৪ থেকে ৪৭ টাকা কেজি বিক্রি করতে হচ্ছে। জরিমানা করে বাজার ঠিক হবে না, সরবরাহ বাড়াতে হবে.’
সাগর রাইস মিলের চেয়ারম্যান মো. মনসুর আলী বলেন, ‘অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারে ধানের ক্ষতি বেশি হয়েছে। তাই ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা মন ধান সবচেয়ে বেশি দামে ১৪০০ টাকা কিনতে হচ্ছে। এ কারণে চালের দাম বেশি। এ ছাড়া সরকারকেও চাল দিতে হচ্ছে। তাই বাজারে চাল দিতে পারছি না। চালের যে অর্ডার নেওয়া আছে তাতে ২০ দিন লাগবে। তাই নতুন করে আর অর্ডার নেওয়া হচ্ছে না।’
মোহাম্মদপুরের জনতা মার্কেটের আখতার জেনারেল স্টোরের আক্তারও বলেন, আমাদের ধরে কী হবে। আমরা কি পণ্যের গায়ে দাম লিখি? যারা কোনো অজুহাত ছাড়াই দাম বাড়াচ্ছে সরকার তাদের ধরুক। তাহলেই বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদেরও একই অভিযোগ। ইউসুফ জেনারেল স্টোররর ইউসুফ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমরা কী বেশি দামে বিক্রি করতে পারি। কোম্পানি বেশি দাম নিচ্ছে। তাই আমাদেরও বেশি দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। কি করলে দাম কমবে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মালের সরবরাহ বাড়ালে দাম কমবে, এর কোনো বিকল্প নেই। সরকারকে তাই গোড়ায় হাত দিতে হবে। আমাদের জরিমানা করে লাভ হবে না।’
লক্ষীপুর জেনারেল স্টোরের ইসমাইল হোসেনও বলেন, এ মুহুর্তে কোনো জিনিসের দাম বাড়েনি। যা বাড়ার আগেই বেড়ে গেছে।
এদিকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে বলা হচ্ছে অযৌক্তিকভাবে সম্প্রতি সব জিনিসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সরবরাহ নেই, নেই অজুহাতে মিলমালিক থেকে পাইকারি, খুচরা ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের কাছ থেকে বেশি দাম আদায় করা হচ্ছে।
এফবিসিসিআই’র সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তাফা আজাদ চৌধুরী বাবু ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আসলে সরবরাহের কোনো সংকট নেই। সংকট হচ্ছে ব্যবস্থাপনার। মিলমালিক, ডিলার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা যে যেভাবে পারছে ভোক্তাদের পকেট কাটছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোই মার্কেট নিয়ে খেলছে। তারা অনেক বেশি দামে চাল, ডালসহ বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করছে। বাজার স্থিতিশীল করার জন্য সরকারের সঙ্গে আমরা কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মজুদ, আমদানি, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি বিষয়ে জানার জন্য মতবিনিময় সভা করছি। সভায় এসব জানতে পারছি।’
এফবিসিসিআই’র সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন সম্প্রতি বলেছেন ‘কতিপয় খারাপ ব্যবসায়ীর অপবাদ ৯৯ শতাংশ ব্যবসায়ীর কাধে পড়তে পারে না। আমরা তাদের নেতা হতে চাই না। চালের দাম ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ভোক্তা অভিযানে গেলে দাম কমে যাচ্ছে কেন? দাম দাড়ানো ন্যায্য হলে কমবে কেন? ’
তিনি বলেন, ‘প্যাকেটজাত পণ্য বিক্রি করার ব্যাপারে একটা নীতিমালা করা দরকার। যে যা ইচ্ছা দাম নেবে তা হতে পারে না।’
জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামানও বলেন, ‘সরবরাহের সংকট দেখিয়ে একেক সময়ে একক রকমের খেলা খেলছে। যে যার মতো খেলছে। কেউ দায় নিতে চাচ্ছে না। কিন্তু অভিযানে গেলেই তা ধরা পড়ছে। অভিযানে গিয়ে গোড়াউনে মাল পাওয়া যাচ্ছে। একইভাবে বাজারে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে তেল-চালের মজুত ধরা পড়ছে।’
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা বাজারে যেতে চাই না। আপনারা ঠিকমতো নিয়ম মেনে ব্যবসা করেন। ভোক্তাদের কষ্ট দেবেন না।’
জেডএ/এনএইচবি/এমএমএ/