ডলারের অস্থিরতার শেষ কোথায়?
টাকার মান দফায় দফায় অবমূল্যায়ন করেও ঠেকানো যাচ্ছে না ডলার সংকট। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিলাসী পণ্যের ঋণ মার্জিন বাড়িয়ে ৭৫ শতাংশ এবং সোমবার টাকার মান ৮০ পয়সা কমিয়ে সাড়ে ৮৭ টাকা করেছে। এর একদিন পরই বিভিন্ন ব্যাংক বলছে ডলার বিক্রি ৯৩ থেকে ৯৭ টাকা। কিন্তু কিনতে চাইলে বলছে ডলার নেই, সংকট। আর চিকিৎসা ও ভ্রমনের জন্য ডলার কেনার কথা বললে সাফ জানিয়ে দিচ্ছে কোনো ডলার নেই। অথচ খোলা বাজারে প্রতি ডলারের দাম বেড়ে ১০৫ টাকায় ঠেকে গেছে। বুধবার (১৮ মে) মতিঝিল, দিলকুশা ও পল্টন এলাকার বিভিন্ন ব্যাংক, মানি এক্সচেঞ্জ অফিস ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।
দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সম্প্রতি আমদানি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এরফলে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার মান কমিয়ে ডলারের দাম বাড়ানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও কাজে আসছে না। বাড়ছেই ডলারের দাম। এতে রপ্তানিকারকরা লাভবান হলেও আমদানি ব্যয় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে ভোক্তাদের উপর। আমদানিকৃত প্রায় জিনিসের দাম কয়েক মাসের ব্যবধানে বহুগুণ বেড়ে গেছে। এরফলে অনেকে আমদানি করা বন্ধ করে দিয়েছেন।
ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের মতিঝিল বৈদেশিক বাণিজ্য শাখায় সরেজমিনে গেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারে বেধে দেওয়া ডলারের রেট ৮৭ দশমিক ৫০ টাকা। বিক্রি কতো জানতে চাইলে বলেন, ‘ডলার নেই। সংকটে আছি।’ তা হলে এলসি কিভাবে হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ‘বড় বড় ব্যাক টু ব্যাক এলসিসহ অন্যান্য এলসি হেড অফিস থেকে হয়ে থাকে। পরিচিত ক্লাইন্ট ছাড়া এলসি করা যাচ্ছে না। এসময় তাজ এন্টারপ্রাইজের শরীফ ঢাকাপ্রকাশ কে বলেন, ‘এভাবে ডলারের সংকট হবে, দাম বাড়বে ভাবতে অবাক লাগছে। আমরা এলসি বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ বেশি মার্জিনে ব্যবসা হবে না। তাছাড়া মার্জিনের টাকা সরবরাহ করাও কঠিন।’
একই বার্তা পাওয়া গেছে পূবালী ব্যাংকের মতিঝিল বৈদেশিক শাখায়। কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেখেন ডলারের রেট ৮৭ দশমিক ৫০ টাকা। তবে বাইরে বিক্রি করা হচ্ছে ৯২ দশমিক ৪০ টাকা ও কেনা হচ্ছে ৯০ দশমিক ২০ টাকা। তাহলে ডলার কেনা যাবে? এমন প্রশ্নের ব্যাপারে তারা বলছেন, ডলার নেই। চরম সংকট। সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু পরিচিত গ্রাহকদের কোনো রকমে এলসি খুলে দেওয়া হচ্ছে। এ মুহুর্তে বাইরে ডলার বিক্রির সুযোগ নেই।
এনসিসি ব্যাংকেও ৮৭ দশমিক ৫০ টাকা ডলার বিক্রি করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। তবে সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাজধানীর প্রায় সকল ব্যাংকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের বেধে দেওয়া ৮৭ দশমিক ৫০ টাকা মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে না।
তবে বুধবার (১৮ মে) বাইরে খোলা (কার্ব) মার্কেটে এক দিনের ব্যবধানে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১০৪ থেকে ১০৫ টাকায়। একদিন আগে মঙ্গলাবার খোলা মার্কেটে ৯৭ থেকে সর্বোচ্চ ১০২ টাকা দরে ডলার বিক্রি করতে দেখা গেছে।
মানি এক্সচেঞ্জ অফিসগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়ে ব্যবসা করলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা সহজে নিয়ম মানছে না। অনেকেই ঝামেলা মনে করে ডলার কিনতে ব্যাংকে যাচ্ছেন না। যার ফলে তাদেরকে বেশি দামেই মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে।
এসব বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘করোনা পনিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হঠাৎ করে আগের আমদানি করা বিলের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি আমদানিও বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই তুলনায় রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়েনি। এজন্য ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। তথ্য দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘গত দুই বছরে আমদানি হয়েছে ৮০ বিলিয়ন (আট হাজার কোটি) ডলার। রপ্তানি হয়েছে ৫০ বিলিয়ন ডলার, ঘাটতি হয়েছে ৩০ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে রেমিটেন্স (প্রবাসী আয়) এসেছে ২০ থেকে ২১ বিলিয়ন ডলার। তারপরও ঘাটতি থাকছে ৯ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে এফডিআই হবে ৬ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার। তারপরও যে ঘাটতি থাকছে তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে সাপোর্ট দিয়েছে এই সময়ে।’
তাহলে তো ডলারের বাজারে সংকট থাকার কথা না। কেন প্রতিনিয়ত অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে? এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘সব কিছুর দাম বিশ্ববাজারে উর্দ্ধমুখী। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে এটা হচ্ছে। এ জন্য ডলারের সংকটও দেখা যাচ্ছে। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার স্থিতিশীল করার জন্য টাকার মান সম্প্রতি কয়েকবার অবমূল্যায়ন করেছে। সর্বশেষ ৮৭ দশমিক ৫০ টাকা করা হয়েছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কার্ব মার্কেট ব্যক্তিভিত্তিক। এটা দিয়ে সারাদেশের জনগণের চিত্র ফুটে উঠে না। কারণ সবাই কার্ব মার্কেটে যায় না। ঝামেলা এড়াতে অনেকে বেশি দাম লাগলেও জরুরি প্রয়োজন মেটাতে কার্ব মার্কেটে ডলার কিনছে। এটা সবার এড়িয়ে চলা উচিৎ। কারণ তাদের ডাইরেক্ট কন্ট্রোল করা যায় না। তবে নিয়মের ব্যত্যয় ধরা পড়লে শান্তি পেতে হবে।
অনেক ব্যাংক বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। এমন ব্যাপারে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করছে ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখা। এ জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া বিলাসী পণ্যে ঋণ মার্জিন বাড়িয়েছে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমন বন্ধসহ আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারপরও কেউ অত্যধিক রেটে ডলার বিক্রি বা ঘোষণার চেয়ে কম-বেশি করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা যাচাই করবে। ধরা পড়লে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সয়াবিন তেলের মতোই কি এভাবে অস্থিরতা চলতে থাকবে ডলারের বাজার? এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ‘যেভাবেই হোক আমদানি কমাতে হবে। রপ্তানি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে প্রবাসী আয় আরও বেশি করে বাড়াতে হবে। এই তিনটাই একমাত্র ডলারের বাজার স্থিতিশীল হওয়ার প্রধান নিয়ামক’।
উল্লেখ্য, বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ সৃষ্টি হওয়ায় রিজার্ভ কমে ৪৬ বিলিয়ন থেকে ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। চলতি অর্থবছরে গত মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে আমদানি ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার ১৫২ কোটি ডলার হয়েছে। রপ্তানি ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে তিন হাজার ৬৬২ কোটি ডলার। এতে করে ২ হাজার ৪৯০ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একই সময়ে আবার রেমিট্যান্স ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ কমে এক হাজার ৫৩০ কোটি ডলারে নেমেছে। এতে করে চলতি হিসাবে রেকর্ড এক হাজার ৪০৭ কোটি ডলারের ঘাটতি হয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে গত সোমবার (১৬ মে) আরও ১০ কোটি ৮০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে সোমবার পর্যন্ত বিক্রি করেছে ৫২১ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
গত বছরের ৩ আগস্ট পর্যন্ত আন্তঃব্যাংকে ডলারের দর ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় অপরিবর্তিত ছিল। এরপর আমদানি বাড়তে থাকায় ডলারের সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে টাকার অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে। গত ১০ মে প্রতি ডলারে ২৫ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করে। সেখান থেকে একটু করে দর বাড়তে বাড়তে এ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে ২ টাকা ৭০ পয়সা। তারপরও সংকট মিটছে না।
এএজেড