মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাড়ানো হলো নীতি সুদ হার
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থ সরবরাহ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদ হার বাড়িয়েছে। যা ৫ দশমিক ৭৫ থেকে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। সোমবার (১৬ জানুয়ারি) থেকেই এ নীতি কার্যকর হচ্ছে। কনজুমার ঋণের সুদ হারও বৃদ্ধির জন্য মৌলিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আস্তে আস্তে অন্যান্য ঋণ ও আমানতেও ক্যাপ (সুদের সীমা) তুলে নেওয়া হবে। এভাবে সতর্কতামূলক নীতি অবলম্বন করে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে।
রবিবার (১৫ জানুয়ারি) মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে নতুন এ মুদ্রানীতি ‘মনিটারি পলিসি স্টেটমেন্ট (এমপিএস)’ প্রকাশ করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাবাজার ও সুদহারের নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য নিয়ে এবারের মুদ্রানীতি করা হয়েছে। আগামীতে এনপিএল (খেলাপি ঋণ) কমা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে কাজ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গভর্নর বলেন, করোনার প্রভাব কাটিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শক্তিশালী হলেও চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সাপ্লাই চেইনে সৃষ্ট সমস্যা আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। তবে সার্বিক দিক বিবেচনা করে বলা যায় বাংলাদেশের অর্থনীতির সহনশীলতা অত্যন্ত গভীর। ধাক্কায় পড়ে যাবে না। বর্তমানে যে অবস্থা তার চেয়ে খারাপ অবস্থায় যাবে না। আশা করি, শিগগির ভালো দিন আসবে।
তিনি বলেন, ‘নতুন অর্থবছরের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। তবে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু উপকরণ ব্যবহার ছাড়া তেমন কোনো করণীয় নেই। যে কয়েকটি উপকরণ রয়েছে, তার অন্যতম প্রধান হলো টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে কম হারে ঋণ দেওয়া। এজন্য চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ প্রথমার্ধের মতো একই হার ধরে দ্বিতীয়ার্ধের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘নীতি সুদ হার বাড়ানো হলেও মূল্যস্ফীতি বাড়বে না। কারণ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন তহবিল গঠন করে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে শূন্য ৫০ থেকে ৪ শতাংশ সুদে দেওয়া হচ্ছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ করা হয়েছে। আগের অর্থবছরে যা ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে বাজেটের বিশাল ঘাটতির অর্থায়নে সরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমায়নি, বরং বাড়িয়েছে। দ্বিতীয়ার্ধে এ লক্ষ্য ঠিক করছে ৩৭ দশমিক ৭০ শতাংশ করা হয়ছে।
মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে, পাশাপাশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ঋণ সরবারহ নিশ্চিত করতে নীতি হার হিসাবে বিবেচিত রেপো (কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ প্রদান) সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭৫ থেকে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো জরুরি প্রয়োজনে অর্থ নিলে গুণতে হবে অতিরিক্ত সুদ।
পাশাপাশি রিভার্স রেপোও ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৪ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা রাখলে ব্যাংকগুলোকে আগের চেয়ে বেশি সুদ পাবে। এ ছাড়া, মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ১২ দশমিক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশে নামানো হয়েছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতিকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে রাখার কথা বলা হলেও গত নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। তাই সার্বিক দিক বিচেনা করে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ ধরা হয়েছে। প্রবৃদ্ধিও কমানো হয়েছে এই মুদ্রানীতিতে। সরকার সাড়ে ৭ শতাংশ ঘোষণা করলেও তা থেকে কমে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক ঋণে জোর দেবে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি পূরণে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেবে বলে লক্ষ্য ঠিক করছে সরকার। এই অংক চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা আছে।
গভর্নর বলেন, ‘চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করেছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। আগের মুদ্রানীতিতে যা ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ ছিল। মূলত সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ বৃদ্ধির প্রবণতা বিশ্লেষণ করে মুদ্রানীতিতে প্রাক্কলন কিছুটা কমানো হয়েছে। এখনই ক্যাপ উঠবে না। ভালো সময় আসলে ঋণ ও আমানতের সুদ হারের সীমা উঠিয়ে নেওয়া হবে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফরাহ মো. নাছেরের, এ কে এম সাজেদুর রহমান খান, বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস, প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হকসহ গবেষণা বিভাগের সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
জেডএ/এমএমএ/