ঠেকানো যাচ্ছে না ঋণের নামে অর্থপাচার
লাগামহীন হয়ে পড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। শীর্ষ ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সুযোগ নিলেও ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করছে না। এমনকি কেউ কেউ ভুয়া কাগজে নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে পাচার করছেন। খেলাপি ঋণ আদায়ে গত ৫০ বছরে প্রায় সোয়া দুই লাখের মতো মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অর্থের পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। এরমধ্যে এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে সোয়া দুই লাখ মামলা। আর অর্থ আদায় হয়েছে মাত্র ২০ হাজার কোটি টাকা।
অথচ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নিয়েই বলেছিলেন, ‘আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। প্রায় চার বছর চলে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কমছে না খেলাপির সংখ্যা।‘
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংকিংখাতে দুর্বল নিয়ন্ত্রক সংস্থার সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা টাকা তুলে পাচার করছে। এতে অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলছে। রক্তক্ষরণ আরও হবে। কমে যাবে বিনিয়োগ।
নামে বেনামে ভুয়া কাগজে ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে বিদেশে পাচার করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক ধরতে পারছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রধান মাসুদ বিশ্বাসও বলেছেন, ইনভয়েসিং ও আন্ডার ভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। তবে কী পরিমাণ তা বলা যাবে না। গোয়েন্দা সংস্থা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা তুলে বিদেশে পাচার করলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনে তাদের বিরুদ্ধে কিছু করা যাচ্ছে না। ফলে আইনের ফাঁকে তারা টাকা পাচার করার পর ধরা পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মামলা করার পর তা আদালতে চলে যাচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেংকারির পর বিসমিল্লাহ গ্রুপ, পিকে হালদারের অর্থ লুটের পর জানাজানি হচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শান্তি না হওয়ায় ব্যাংকের টাকা লুট করার প্রবণতা ঠেকানো যাচ্ছে না। সম্প্রতি নাবিল গ্রুপ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছে। এ নিয়ে দেশে হইচই পড়লে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবার (২৬ নভেম্বর) মন্ত্রিসভা বৈঠকে খেলাপি ঋণের বিষয়ে বাস্তব চিত্র জানাতে সংশ্লিদের নির্দেশ দেন। এর পরই বাংলাদেশ ব্যাংক নড়েচড়ে বসেছে।
গত ২৭ নভেম্বর দুদকের উদ্দেশে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘ঋণখেলাপিরা আইনের চেয়ে শক্তিশালী নয়। তাহলে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হচ্ছে। আপনারা ধরছেন না কেন? এক টাকাও খেলাপি বাড়বে না। অর্থমন্ত্রীর সেই বক্তব্য জানার জন্য মঙ্গলবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন না ধরায় মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
খেলাপি ঋণের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জিএম আবুল কালাম আজাদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘ ক্লাসিফাইড (খেলাপি) ঋণ বেড়েছে, এটা সত্য। তবে খেলাপি ঋণ কমানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। কারণ জনগণের আমানত থেকেই ঋণ দেওয়া হয়। খেলাপি ঋণ কমানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্তক আছে, কঠোর পথে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তার গাইড লাইন মোতাবেক কাজ করে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন ও সুপারভিশনে আরও বেশি জোর দিয়েছে।’
হুহু করে বাড়ছে খেলাপি, মামলা করেও আদায় হচ্ছে না। এর কারণ কী জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘বড় বড় খেলাপিরা কয়েক হাজার কোটি টাকা করে তুলে নিচ্ছে। মামলা হলেও তারা ফেরত দিচ্ছে না। কারণ ১ লাখ ৪৫ হাজার মামলায় মাত্র ২০ হাজার কোটি টাকা আদায় হয়েছে অর্থাৎ প্রতি মামলায় ১৪ হাজার ১১৯ টাকা। এটা ছোট ছোট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে। কিন্তু রাঘববোয়ালদের হাজার হাজার কোটি টাকার কিছুই হচ্ছে না। মানে যারা বড় খেলাপি তাদের ধরা হচ্ছে না। এটা খুবই ভয়াবহ চিত্র।
তিনি বলেন, তাদের মনে ঢুকে গেছে ব্যাংকের ঋণ নিলে ফেরত না দিলেও চলে। এই সংস্কৃতি খেলাপিদের মধ্যে ঢুকে গেছে। তাই ব্যাংক বাঁচাতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। তাহলেই খেলাপি ঋণ কমবে। জনগণের আমানত হেফাজতে থাকবে।
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, খেলাপি ঋণ এমনিতেই ব্যাংক খাতের জন্য সমস্যা। তাই যারা ঋণ পরিশোধ করছে না তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অ্যাকশনে যেতে হবে। এর সঙ্গে কোনো ব্যাংকার, পরিচালক জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে অর্থনীতির ক্ষতি তো হচ্ছে, রক্তক্ষরণ আরও হবে। বিনিয়োগে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যেহেতু রাজনৈতিকভাবে অনেকে ব্যাংকের টাকা তুলে নিচ্ছে, তাই খেলাপিদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে রাজনৈতিকভাবে। কারণ ব্যাংকের টাকা মানে জনগণের আমানত লুণ্ঠন করছে তারা।’
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, করোনার সময় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সরকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে তৈরি পোশাকশিল্পসহ অন্যান্য খাতের বড় বড় শীর্ষ ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের সুযোগ দিয়েছে। তারপরও খেলাপি ঋণ কমছে না। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ১৩ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। কিন্তু ব্যাংক মালিক থেকে শুরু করে এক শ্রেণির সুবিধাবাদি ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অনেকে ঋণ ফেরত দিচ্ছে না। ফলে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। এরমধ্যে আদায় অযোগ্য (ব্যাড লোন) ঋণ হচ্ছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা বা প্রায় আট শতাংশ। গত তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
প্রতি মামলায় আদায় ১৪ হাজার টাকা!
বিভিন্নভাবে তাগিত দিয়েও অনেকে ঋণ ফেরত দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে অর্থঋণ আদালতে মামলাও করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কু-ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় অনেক ব্যাংক প্রভিশনও রাখতে পারছে না। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ১৩ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা। সাধারণত ঋণের মেয়াদ অতিবাহিত হওয়ার পর মামলা মোকদ্দমা করলেও ৫ বছরে কোনো ঋণ আদায় করতে না পারলে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এগুলো ব্যাড ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই ঋণের বেশির ভাগই আদায় অযোগ্য হয়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে (৩০ জুন) দেখা গেছে, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক খেলাপি আদায়ে মামলা করেছে ২ লাখ ১৪ হাজারের বেশি। এসব মামলায় দাবিকৃত অর্থের পরিমান হচ্ছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ৬ মাস আগে অর্থাৎ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মামলা ছিলো প্রায় ২ লাখ ৮ হাজার। এর বিপরীতে দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার মতো। ছয় মাস পর পর খেলাপি মামলার প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা এখনো প্রকাশ করেনি।
তবে বিভিন্ন সূত্রে মতে, আগামী ডিসেম্বরে মামলা সোয়া ২ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। আর দাবি করা অর্থের পরিমাণ আড়াই লাখ কোটি টাকা হবে। কারণ মামলা করলেও ঋণ আদায় হচ্ছে না। গত জুন পর্যন্ত নিষ্পত্তি করা ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬২৫টি মামলায় অর্থ আদায়ের দাবির পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা। তাতে আদায় হয়েছে মাত্র ২০ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ মামলাপ্রতি ১৪ হাজার ১১৯ টাকা। আর বিচারাধীন মামলা রয়েছে ৬৯ হাজার ৩৬৯টি। তাতে দাবির পরিমাণ ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এতে অর্থ আদায় হয়েছে ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে অর্থঋণ আদালতে মামলা ছিল প্রায় ২ লাখ ৮ হাজার। দাবি করা অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এ সময় পর্যন্ত নিষ্পত্তি করা মামলা ছিল প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার। দাবি করা অর্থের পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে আদায় হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। আর বিচারাধীন ৬৮ হাজার মামলার মধ্যে দাবি করা অর্থের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। তাতে অর্থ আদায় হয়েছে ৪ হাজার ৬১০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকে আমানত জমা হয়েছে ১৬ লাখ ২৮ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। এই আমানত থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে ১৩ লাখ ৫১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা বা মোট আমানতের ৮৩ শতাংশ। এখানে নিয়ম মানা হলেও আদায়ে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র।
সর্বশেষ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে ঋণস্থিতি হচ্ছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এরমধ্যে খেলাপি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গ্রাহকরা ঠিকভাবে ঋণ পরিশোধ করছে না। ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ঋণ পরিশোধ না করায় শুধু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও কৃষকদের জেল খাটানো হলেও রাঘববোয়ালরা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি বা ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। এই খেলাপি ঋণের ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যাড বা আদায় অযোগ্য হয়ে গেছে।
এনএইচবি/এসএন