ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ
এজেন্ট ব্যাংকিং থেকে শুরু করে মোবাইল ব্যাংকিং, কৃষিঋণ, আমানত জমাসহ প্রায় সব খাতেই বিভিন্ন ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ৫০ হাজারের বেশি অভিযোগ পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। করোনাকালে এই অভিযোগ বেড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে অভিযোগ বেড়েছে ২৭ শতাংশ। দুই বছরের ব্যবধানে এই অভিযোগ সব রেকর্ড ছাড়িয়ে হয়েছে ৮৭ শতাংশ।
গ্রাহকরা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ৬৩৩টি অভিযোগ করলেও বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অভিযোগ জমা পড়েছে ৬ হাজার ৭৯৮টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ এক প্রতিবেদনে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে।
অথচ ব্যাংকিং সেবা ভালোভাবে নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে গাইডলাইন ও সার্কুলার ইস্যু করছে। তারপরও গ্রাহকরা ব্যাংকগুলো থেকে প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংকিং সেবার বিভিন্ন জায়গায় গ্রাহকদের হয়রানির শিকার থেকে রক্ষা করা, আর্থিক খাতের সামগ্রিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণে সর্বপ্রথম ২০১১ সালে একটি ‘হেল্পডেস্ক’ চালু করা হয়। পরে গ্রাহকের কথা আরও বেশি করে আমলে নিয়ে ‘গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্র” থেকে সর্বশেষ ২০১২ সালে ‘ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্ট (এফআইসিএসডি) ‘ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগ গঠন করা হয়। সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সময় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। তিনি প্রতি বছর গ্রাহক অভিযোগের তথ্য প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করতেন। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক সেবার মানকে নিরবচ্ছিন্ন ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, কিন্তু বিভিন্ন ব্যাংকের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু পুরোপুরি প্রতিকার না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে গ্রাহকরা বাংলাদেশ ব্যাংকে তাদের অভিযোগ জানাতে থাকেন।
জানা গেছে, অভিযোগের মাধ্যমেই ফেরদৌসি জামান নামে এক গ্রাহক তার একটি সঞ্চয়ী হিসাবের প্রায় ৬ কোটি ৬১ লাখ টাকার মধ্যে ৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ফেরত পান। কারণ তিনি ২০১৬ সালে বেসরকারি একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন। কিন্তু ব্যাংকের তৎকালীন অ্যাসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সেন্টার ম্যানেজার সরওয়ার তা বিভিন্নভাবে তুলে নেন। ওই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা খোয়া যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু তা ফেরত দিতে গড়িমসি করেন। বাধ্য হয়ে ফেরদৌসি জামান বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেন। এতে নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা বিভিন্নভাবে তদন্ত করে জানতে পারে গ্রাহকের অজান্তেই চারটি চেক বই ব্যবহার করে ওই গ্রাহকের সব টাকা সরওয়ার উত্তোলন করেন।
জানা গেছে, এভাবে গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠার পর যে কেউ প্রতারিত হয়ে অভিযোগ করলেই তার প্রতিকার পাচ্ছেন। প্রতি বছর সেই অভিযোগের তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা হয়। সর্বশেষ ২০১৮-২০১৯ বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে জানানো হয়েছে ২০১১ সাল হতে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের বিরুদ্ধে ৩৪ হাজার ৬৭৮টি অভিযোগ পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে।
একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে অভিযোগ পড়ে ৩ হাজার ৬৩৩টি। এরমধ্যে নিষ্পত্তির হার ১০০ শতাংশ। ২০-২১ অর্থবছরে ৪ হাজার ৯৭৪টি অভিযোগ পড়ে। নিষ্পত্তি হয়েছে ৯৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর সর্বশেষ বিদায়ী অর্থবছরের (২০২১-২২) জুন পর্যন্ত অভিযোগ জমা পড়ে ৬ হাজার ৭৯৮টি। নিষ্পত্তির হার ৯০ দশমিক ৭১ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ গত জুন পর্যন্ত অভিযোগ বেড়েছে ১ হাজার ৮২৪টি বা ৩৭ শতাংশ। আর (২০১৯-২০২০ থেকে ২০২১-২০২২) দুই বছরের ব্যবধানে অভিযোগ বেড়েছে ৩ হাজার ১৬৫টি বা ৮৭ শতাংশ। এভাবে শুরু থেকে গত জুন পর্যন্ত এই অভিযোগ ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। টেলিফোন, সরাসরি, পত্র বা ই-মেইলের মাধ্যমে এসব অভিযোগ করা হয়।
কিন্তু আগে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা হলেও গত তিন অর্থবছর ধরে তা আর প্রকাশ করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তথ্য প্রদানেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ফলে অনেক কর্মকর্তারা ভয় ও আতঙ্কে রয়েছেন। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলার পরও অনেক কর্মকর্তা ভয় পাচ্ছেন তথ্য দিতে। কারণ সম্প্রতি পরিচালক থেকে শুরু করে কয়েকজন নির্বাহী পরিচালককেও এক ডেপুটি গভর্নর সতর্ক ও কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন। ফলে কোন ব্যাংকের বিরুদ্ধে কত অভিযোগ তা জানা যায়নি। অথচ আগে মুখপাত্র বলার পর কর্মকর্তারা তথ্য সরবরাহ করতেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, গত তিন বছরে অভিযোগ পড়েছে ১৫ হাজার ৪০৫টি। নিষ্পত্তিও করা হচ্ছে। এই হার গড়ে ৯৭ শতাংশ। সব অভিযোগেরই প্রতিকার গ্রাহকরা যেন পান আমরা সেই চেষ্টা করছি। কেউ অভিযোগ করলেই তার প্রতিকার মিলছে।
উল্লেখ্য, ব্যাংকগুলোতে গ্রাহক সেবা ও তাদের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ২০১৪ সালের ১৩ জুলাই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘গ্রাহক সেবা ও অভিযোগ ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক একটি নীতিমালা জারি করা হয়। সেই আলোকে কোনো গ্রাহক অভিযোগ করলে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হয়।
এনএইচবি/এসএন