কোনো উদ্যোগেই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না ডলারের বাজার
ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। জুলাইয়ে দেশে রেকর্ড পরিমাণ রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স আসলেও যতই দিন যাচ্ছে দেশের বাজারে ডলারের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বুধবার ব্যাংক রেট ডলার ৯৫ টাকার নিচে রাখলেও বৃহস্পতিবার তা ৯৫ টাকা দরে বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ব্যাংকের বাইরে হুন্ডির মাধ্যমে বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ হাউজে প্রতি ডলার ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ডলারের বাজার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু মুখে বললে হবে না, ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। মুদ্রানীতিতে ব্যয় সংকোচন করলেও আমদানি ব্যয় কমবে না। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ আসার পথ বন্ধ করতে হবে। বৈধপথে অর্থ আনার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানায়, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই দেশে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। এজন্য গত এপ্রিল মাসে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা হলেও পরের মাস থেকে চাহিদা বাড়তে থাকে। তারপর থেকে ডলারের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৪ দশমিক ০৯ শতাংশ। আর আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৯ শতাংশ। তবে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে নেতিবাচক ১৬ শতাংশ। এর ফলে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। এই ঘাটতি মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ৪৮ বিলিয়ন থেকে রিজার্ভ কমে ২৭ জুন হয়েছে ৪১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। কমতে কমতে বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট) রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। গত ২৭ জুন ডলারের বিনিময় হার ছিল ৯২ দশমিক ৯৫ টাকা। যা ২০২১ সালের জুনে ছিল ৮৪ দশমিক ৮১ টাকা।
বাজার স্থিতিশীল করতে ডলার বিক্রিও অব্যাহত রয়েছে। চাপ কমাতে বৃহস্পতিবার (১১আগস্ট) ১২ কোটি ২০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে ৯৫ টাকা দরে। আর আগস্ট মাসে বিক্রি করা হয়েছে ৫৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেখানে বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজার থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ডলারের চাপ কমাতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশ ভ্রমণ, বিলাসী পণ্যে ১০০ শতাংশ ঋণ মার্জিনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করেছে, যা কিছুটা সংকোচনমুখী বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে।
বিদায়ী অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতেও প্রবাসীরা ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার (২ দশমিক ১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩৯৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি।
কিন্তু নানামুখী উদ্যোগের পরও ডলারের বাজারের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। প্রায় দিন বাড়ছে ডলারের দাম। বাধ্য হয়ে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক করে ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর হওয়ার আবেদন জানিয়েছে।
ব্যবসায়ী নেতাদের সাক্ষাতের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘ডলারে অনিয়ম পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নেওয়া মানি এক্সচেঞ্জগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো দরে ডলার বিক্রি করছে। ব্যাংকের চেয়ে বেশি দামে ডলার বেচা-কেনা করছে। তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘বিভিন্ন শর্তপূরণ করে ২৩৫টি মানি এক্সচেঞ্জ অফিস অনুমোদন নিয়েছে। তারা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটালে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি ৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। আরও দুটি নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তারা নিয়ম না মানলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। আমরা বাজারে বিভিন্ন টিম পাঠিয়েছি। ডলারের কারসাজি হচ্ছে কি না তা ধরতে অভিযান শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডলার নিয়ে কারসাজি করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে এখন পর্যন্ত বিসমিল্লাহ মানি এক্সচেঞ্জ, অঙ্কন মানি এক্সচেঞ্জ ও ফয়েজ মানি এক্সচেঞ্জসহ ৫টি মানি একচেঞ্জকে চিহ্নিত করে তাদের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সর্বাত্বক চেষ্টা করছে। বেশি পরিমাণ এলসি ওপেন করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে। এই পদ্ধতি চালু করার পর কিছু গরমিলও পাওয়া গেছে। এ কারণে জুলাই মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের এলসি কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জানান, মোবাইল ব্যাংকিং নিয়েও আমরা কাজ শুরু করেছি। আমাদের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগ দেখছে বিকাশ, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে কোনো হুন্ডির সম্পৃক্ততা আছে কি না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে ২০২১ সালের জুন থেকে টাকার অবমূল্যায়ন ৮৪ দশমিক ৮১ টাকা থেকে ২০২২ সালের আগস্টে ৯৪ দশমিক ৭০ টাকা করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকে ডলার সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। গত জুলাই মাসে ১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে, আর বিদায়ী অর্থবছরে ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। যেখানে আগের অর্থবছরে কেনা হয়েছিল ৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জের অনিয়ম চিহ্নিত করতে ১০টি টিম সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে। ৫টি মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স বাতিল ও ৪৫টি মানি এক্সচেঞ্জকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডলার সংকট নিরসনের জন্য বিলাসবহুল দ্রব্যসহ ২৭ ধরনের পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ মার্জিন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। ব্যাংকের গাড়ি কেনাসহ কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ সীমিত করা হয়েছে।’
এনএইচবি/এসজি/