অনলাইনেই চলছে ইয়াবা বিক্রির হিড়িক!
রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অবাধে মিলছে প্রায় সব ধরনের মাদক। এক সময় স্পটভিত্তিক মাদক বিক্রি হলেও এখন ছড়িয়ে গেছে সবখানে। র্যাব-পুলিশের তথ্য বলছে, ইয়াবা ছোট হওয়ায় এটি বহনে বেশ আরামদায়ক মনে করে মাদক কারবারির। এজন্য তারা, বর্তমানে ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, বা অন্যান্য সামাজিক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনের মাধ্যমে ইয়াবা বিক্রির করছে।
সেবনকারীরা বলছে, এখন আর মাদক নিতে স্পটে যাওয়া লাগে না ঘরে বসে ফোনে অর্ডার করলেই পৌঁছে যায় পছন্দের মাদক, ইয়াবা। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, বর্তমানে স্মার্টনেস ধরে রাখার জন্য নারীরাই বেশি ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে।
সস্প্রতি র্যাব-৬ এর এক অভিযানে মাদক বহনকারী নারী অনন্যা ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর র্যাব জানায়, ওই নারী মূলত ইয়াবা সেবনকরী। তিনি তার স্মার্টনেস ধরে রাখার জন্য পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ইয়াবায় আশক্ত হন।
অনন্যা ইসলাম গ্রেপ্তারের পর এসব কথা বলেছেন তিনি নিজেই।
এ বিষয়ে র্যাব-৬ এর কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট. নজরুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বর্তমানে অনেক নারীরা ইয়াবায় আশক্ত। মাদক কারবারিরা নারীদের প্রথমে স্মার্টনেস ধরে রাখতে ইয়াবা সেবনে করতে কাউন্সিলিং করে। পরে নারীরা ওই প্রলোভনে পড়ে ইয়াবায় আশক্ত হয়।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আকলিমা আক্তারের নিকট থেকে ইয়াবা উদ্ধারর পর পুলিশ বলছে, কৃষি কর্মকর্তা আকলিমা আক্তারসহ তারা ৩ বান্ধবী মাঝে মাঝে ঢাকায় বেড়াতে যান এবং সেখানে গিয়ে তারা বান্ধবীদের সঙ্গে ইয়াবা সেবন করেন।
আকলিমার দাবি, তিনি একটু মোটা এজন্য তিনি চিকুন হতে ইয়াবায় আশক্ত হন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আড়াইহাজার থানার (ওসি) আজিজুল হক হাওলাদার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমরা মাদকবিরোধী অভিযানে বেশ কিছুদিন আগে ইয়াবাসহ এক সরকারী কর্মকর্তাসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর জানতে পারি তারা ৩ বান্ধবী একসঙ্গে মিলে মাঝে মাঝে ঢাকায় বেড়াতে যান এবং সেখানে গিয়ে রাখতে তারা ইয়াবা সেবন করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, মাদকের বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলা ও মাদকের অপব্যবহার বিরোধী অভিযান চলমান থাকলেও কিছুতেই থামছে না ইয়াবা সেবনকারীদের সংখ্যা। এসব নিয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে এখন পাড়া মহল্লায় ছড়িয়ে পড়েছে ইয়াবার মতো ভয়াবহ মাদক। এটি সেবনকারীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় মাদক। এই মাদকে বেশির ভাগ উঠতি বয়সী যুবক-যুবতীরা আসক্ত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক একজন মাদকসেবী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ঢাকায় এখন ইয়াবা সর্বত্রই, বিশেষ করে এটির ডিলার যারা তাদের ফোন করলেই গন্তব্যে দিয়ে যায়। পুলিশের তেমন কোনো ঝামেলা থাকে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি তথ্য বলছে, ২০১১ সালে মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়েছিল ৩৭ হাজার ৩৯৫টি, আসামি ছিল ৪৭ হাজার ৪০৩ জন। ২০১৭ সালে মামলার সংখ্যা ১ লাখ ছয় হাজার ৫৩৬ জন, আসামি এক লাখ ৩২ হাজার ৮৮৩ জন। ওই তথ্য জানায়, ইয়াবা ছোট হওয়ায় সুবিধাজনকভাবে পরিবহণ করে এটি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিচ্ছে মাদক কারবারিরা।
ডিএমপির একটি সূত্র মতে, গত বছরের ডিএমপির মাদক বিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় ১৬ হাজারের ও বেশি মাদক কারবারি ও সেবনকারীদের। এর মধ্যে ইয়াবার মামলা বেশি এবং বর্তমানে নারীর সংখ্যাও বেশি। চলতি বছর ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ৭ ফ্রেবরুয়ারি পর্যন্ত ৪৯০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০০ জন নারী রয়েছে।
ডিএমপির তথ্য বলছে, শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন মাদক মামলা হয় প্রায় শতাধিক। তবে আগের তুলনায় নারীরা এসব ঘটনার সঙ্গে বেশি জড়িত হচ্ছে।
এদিকে, কারাগার সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে কারাগারে অন্যান্য অপরাধীদের চেয়ে মাদক সেবন ও কারবারির সংখ্যা বেশি। ওই সূত্রটি জানায় কারাগারে প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ কয়েদিই মাদক মামলার আসামি। কারা সদর দপ্তরের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, সারা দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ লাখেরও বেশি।
তিনি বলেন, কিন্তু সারা দেশে সরকারি বেসরকারি মিলে নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ৭ হাজারের মতো।
বনশ্রীতে সরেজমিনে দেখা যায়, এ বি ব্লকের আল্লাহর দান হোটেলের গলিতে কিছুটা গোপনে ইয়াবা বিক্রি করেন নাহিদ হাসান।
তিনি বলেন, এখন আর ইয়াবা রাস্তায় দাড়িয়ে বিক্রি করতে হয় না। সবাই ফোন নম্বর নিয়ে যায়। দরকার হলে তারা ফোন দিয়ে ঠিকানা দেয়, আমি ইয়াবা পাঠিয়ে দেই বা আমি নিজেই দিয়ে আসি। এই মাধ্যমে বেশি নিরাপত্তা আছে। তবে মাঝে মাঝে এলাকার কিছু বড় ভাইদের গলিতে দিয়ে আসি।
বাড্ডা ও বসুন্ধরা এলাকায় নাম করা মাদক ব্যবসায়ী বাবুল হোসেন বলেন, আগে আমি কালের কন্ঠের প্রেসে চাকরি করেছি। চুরির মামলার কারণে আমার চাকরি চলে যায়। এরপর জেল থেকে বের হয়ে আমি ইয়াবার ডিলার নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করি। কয়েকবার ইয়াবা বা বিভিন্ন মাদক নিয়ে ধরা পড়েছি এরপরে এই পথেই চলে এসেছি। কিছু টাকা-পয়সা বানিয়ে মাদক ব্যবসা ছেড়ে দেবেন তিনি।
মহাখালী কড়াইল এলাকার মাদক ব্যবসায়ী রুবেল হোসেন বলেন, ‘পুলিশ আমাকে কয়েকবার ধরে চালান দিয়েছে। আমার নামে ১০টা মাদক মামলা ও ১ টি অস্ত্র মামলা রয়েছে । আর বেশি দিন মাদক ব্যবসা করা যাবে না । বিয়ে-শাদি করতে হবে এসব ছেড়ে অন্য ব্যবসা করব।
মিরপুর এলাকার ছোট মাদক ব্যবসায়ী রাত্রি শাকিল বলেন, বড়লোক হতে মাদক ব্যবসা এবং মডেলদের হাতে রেখেছি। নিজে ও স্মার্ট হতে এটা সেবন করি। কিন্তু বিভিন্ন স্পট পরিবর্তন করতে হয় এবং বিলাসবহুল বাসা নিতে হয়, যার কারণে আগের মত আর ইনকাম হয় না। এজন্য অন্য কিছু চিন্তা করছি।
আগারগাঁও তালতলা এলাকার মাদক ব্যবসায়ীর ছদ্মনাম দিদি। দিদির তথ্য মতে, বড় হওয়ার উপরের লাইন হলো মাদক ব্যবসা। তা ছাড়া, ইয়াবায় অনেক লাভ এজন্য মাদকের মধ্যে ইয়াবার ব্যবসাটাই বেশি করি।
হাতিরঝিল মোতালেব প্লাজা এলাকার নামকরা মাদক ব্যবসায়ী মডেল মৌ আক্তার বলেন, কয়েক বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়। সেও ইয়াবা সেবন করত, আমিও তার দেখাদেখি সেবন করা শুরু করি। এক পর্যায়ে আমি এবং সে এক সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, এরপর থেকে ইয়াবা ব্যবসা শুরু করেছি। তবে এই ব্যবসা করলে নিজের ইয়াবা খাওয়া চলে যায়।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, শুধু ইযাবা নয় বিভিন্ন মাদক নিয়ন্ত্রণে র্যাব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছে। তবে ইয়াবা ছোট হওয়ায় এটি বহনে সুবিধা হয় এজন্য মাদক সেবন ও কারবারিরা এই মাদকের প্রতি বেশিই আশক্ত।
তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা গেছে আমাদের অভিযানে নারী মাদক ব্যবসায়ীরা গ্রেপ্তার হচ্ছে। যা বিগত দিনের তুলনায় একটু বেশি।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এখন অনলাইনেও মাদক বিক্রি হচ্ছে তবে এ ক্ষেত্রে বেশি ইয়াবার নাম সামনে এসেছে। কিছু ব্যবসায়ী বা সেবনকারীদের গ্রেপ্তারের পর জানা গেছে মাদক কারবারিরা খুচরা ক্রেতা ও সেবনকারীদের বাসায় বাসায় হোম ডেলিভারি দিয়ে থাকে।
মঈন বলেন, ইয়াবা বা অন্যান্য মাদক নিয়ন্ত্রণ বা দমনে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে সামজিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে তাহলে এটি নিয়ন্ত্রণ অনেকটা সহজ হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি যারা ইয়াবা সেবনের অপরাধে গ্রেপ্তার হয় তাদের অনেকেই যুবতী। বর্তমানে নারীরাই ইয়াবার সঙ্গে বেশি যুক্ত হচ্ছে।
ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, আমাদের দেশে কোনো মাদক তৈরি হয় না। আশেপাশের বিভিন্ন দেশ থেকে আসছে বিভিন্ন ধরনের মাদক। বিশেষ করে ইয়াবা আমাদের দেশে চাহিদা বেশি গোয়েন্দা তথ্যে এটা উঠে এসেছে। এতে উঠতি বয়সী নারীরা আসক্ত হচ্ছে। ইয়াবা বা অন্যান্য মাদক দমনে দেশের সচেতন মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। তা ছাড়া, পরিবারের কর্তার সন্তানদের প্রতি বা তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি খোঁজ খবর নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সবাই সামাজিকভাবে এগিয়ে এলে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের চাহিদা কমে আসবে।
স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সবার আগে ইয়াবা থেকে দেশের যুব সমাজকে বাঁচাতে হবে। মাদকের ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। দেশ বাঁচাতে ইয়াবা কারবারিদের কোনো ছাড় নেই। তাদের ধরতে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযান চলমান রয়েছে।
এমএমএ/