২০ হাজারে বিক্রি লাখ টাকার জাল নোট!
প্রায় এক কোটি টাকা মূল্যের জাল নোটসহ জাল টাকা তৈরি চক্রের অন্যতম হোতা মো. মাউন হোসেন সাব্বির ও তার সহযোগীসহ চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
র্যাব বলছে, চক্রটির অন্যতম হোতা সাব্বির ও এই চক্রের সঙ্গে আরও ১৫-২০ জন সদস্য জড়িত রয়েছেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় চক্রের সদস্যরা প্রতি এক লাখ টাকা মূল্যের জাল নোট ১৫-২০ হাজার টাকায় বিক্রি করত।
গ্রেপ্তাররা হলেন— সংঘবদ্ধ জাল নোট তৈরি চক্রের মো. মাউন হোসেন সাব্বির (২১), মো. পারভেজ (২০), মো. তারেক (২০) ও মো. শিহাব উদ্দিন (২০)।
রাজধানীর চকবাজার থানার মিটফোর্ড এলাকা, সিরাজগঞ্জ সদর এবং খুলনা জেলার খালিশপুর থানা এলাকায় পৃথক অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেপ্তার করে র্যাব-৪।
এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রায় এক কোটি টাকার সম মূল্যের জাল নোট (যার মধ্যে ১০০০, ৫০০, এবং ১০০ টাকার সমমানের জাল নোট রয়েছে), ১টি ল্যাপটপ, ১টি প্রিন্টার, ১টি পেনড্রাইভ, এন্টি কাটার ১টি, টাকার পাঞ্চিং ১ রোল, জিলেটিং ৫০০ গ্রাম, প্রিন্টারে ব্যবহৃত কালির খালি বোতল ১২টি, গালা ৫০০ গ্রাম, স্পিরিট ৬ বোতল, ফেবিকল আঠা ৬ বোতলসহ জালনোট তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়।
রবিবার (২৩ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ সব কথা জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাব জানায়, তারা পরস্পর যোগসাজশে প্রায় এক বছর ধরে ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, খুলনা ও যশোরসহ বিভিন্ন এলাকায় জাল নোট তৈরি করে কম দামে বিক্রি করতেন। এ ছাড়াও এ চক্রের সদস্যরা নিজেরাও বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং দোকান, মাছের আড়ৎসহ জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় জাল নোট ব্যবহার করত। এ চক্রটির অন্যতম হোতা মাউন হোসেন সাব্বির এবং এই চক্রের সঙ্গে আরও ১৫-২০ জন সদস্য জড়িত রয়েছেন বলে জানা যায়। তারা কম সময়ে অল্প পুঁজিতে ধনী হওয়ার লোভে এই প্রতারণার আশ্রয় নেন।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা জানায়, ইউটিউব ও ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে জাল টাকা তৈরি ও ব্যবসার প্রতি তারা আকৃষ্ট হয়। চক্রের অন্যতম হোতা সাব্বির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেইজে পরিচালিত একটি গ্রুপ ‘জাল টাকা প্রতারক চক্র বিরোধী পোস্ট’ এর মাধ্যমে গ্রেপ্তার অপর সদস্যদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরবর্তীতে তিনি জাল নোটের খুচরা ব্যবসা করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অপর একটি জাল নোট তৈরি চক্রের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
র্যাব কর্মকর্তা কমান্ডার খন্দকার মঈন বলেন, চক্রটির কাছ থেকে তিনি তিন লাখ টাকার জাল নোট বিক্রির জন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এক ব্যক্তিকে ৩৫ হাজার টাকা পাঠান। জাল নোট কেনার জন্য তিনি অর্থ দিলেও চক্রটি তাকে কোনো জাল নোট দেয়নি। চক্রটির কাছ থেকে তিনি জাল নোট না পেয়ে নিজেই জাল নোট তৈরির জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা প্রথমে মেসেঞ্জারে X-MAN নামে একটি গ্রুপ খুলে জাল টাকা তৈরি-ব্যবসার বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান করেন। এই গ্রুপের অ্যাডমিন হিসেবে শিহাব কাজ করতেন।
কমান্ডার মঈন বলেন, শিহাবের মাধ্যমে অপর দুই সদস্য পারভেজ এবং তারেকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরবর্তীতে তিনি ইউটিউব, ফেসবুক এবং গুগল ঘেটে জাল নোট তৈরির বিভিন্ন বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান অর্জন করেন এবং বিভিন্ন সময়ে জমানো অর্থ দিয়ে জাল নোট তৈরির জন্য ল্যাপটপ, প্রিন্টার, প্রিন্টিং ডাইস, পেনড্রাইভ, কাগজ, টিস্যু পেপার ও প্রিন্টারের কালিসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি কিনতেন।
র্যাব মুখপাত্র বলেন, সাব্বির জালনোট তৈরির সার্বিক বিষয়ে দক্ষ হওয়ায় সবকিছু তিনি নিজেই পরিচালনা করতেন। যখন জাল নোটের ব্যবসা রমরমা থাকে তখন চক্রটি দৈনিক দুই লাখের বেশি টাকা মূল্যমানের জাল নোট তৈরি করত। মূলত তারা একটি অভিনব কায়দায় জাল নোটগুলো বিক্রি করতেন। তারা তাদের আগের ফেসবুক গ্রুপে ‘জাল টাকা প্রতারক চক্র বিরোধী পোস্ট’ থেকে কমেন্টস দেখে তাদের সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে ক্লাইন্ট তৈরি করে জাল টাকার ব্যবসা করতেন।
তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চক্রের সদস্যেদের মাধ্যমে ঢাকাসহ সিরাজগঞ্জ, খুলনা, যশোর এলাকায় সরবরাহ করত চক্রটি। তারা কখনো সরাসরি জাল নোটগুলো ক্লাইন্টকে দেখাতেন না। গ্রুপ থেকে ক্লাইন্টদের সিলেক্ট করে তাদের সঙ্গে ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে কথা বলে তাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে নিত। তারা প্রতি এক লাখ টাকা মূল্যের জাল নোট ১৫-২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করতেন।
খন্দকার মঈন বলেন, চক্রটি মূলত জাল নোট তৈরি ও বাজারজাতকরণের জন্য ঢাকাকে নিরাপদ ও সহজ স্থান বলে মনে করতেন। চক্রটি সাধারণত বিভিন্ন মেলা, উৎসব, পূজা, ঈদে পশুর হাটে ও অধিক জন-সমাগম অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে জাল নোট ব্যবহার করতেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে জালনোট প্রিন্টিংয়ের সময় কাগজের অব্যবহৃত ও নষ্ট অংশগুলো পুড়িয়ে ফেলতেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে তাদের কাজ পরিচালনা করতেন। এ পর্যন্ত চক্রটি বিভিন্ন সময়ে প্রায় দুই কোটি মূল্যমানের জাল নোটের ব্যবসা করেছে বলে জানা যায়।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তার সাব্বির মিটফোর্ডে তার দুঃসম্পর্কের মামার ঔষুধের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ঢাকার একটি কলেজে অনার্স ১ম বর্ষে অধ্যায়নরত। তিনি তার নিজ পেশার আড়ালে জাল নোট তৈরি চক্রটির অন্যতম হোতা হিসেবে প্রায় এক বছর ধরে চক্রটি পরিচালনা করছিলেন।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার শিহাব ও পারভেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন পেইজ ও গ্রুপে জাল নোট ব্যবসার সংবাদ দেখে জাল টাকার ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হয়। পরবর্তীতে শিহাবের মাধ্যমে পরিচয়ের সূত্রে চক্রটির সঙ্গে জড়িত হয় তারা। তারা ইউটিউবে ভিডিও দেখে জাল টাকা তৈরি করা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে।
গ্রেপ্তার তারেকের শিহাবের মাধ্যমে সাব্বিরের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সাব্বিরের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে তিন চক্রটিতে জড়িত হন। তিনি স্থানীয় বাজার থেকে জাল নোট তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনতেন।
তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান র্যাব মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার মঈন।
কেএম/আরএ/