সীমান্ত এলাকা থেকে অস্ত্র ঢুকছে ঢাকায়, বহন করছেন নারীরাও
সরকারি বাহিনীর চোখ এড়াতে নানা কৌশলে অবৈধ অস্ত্রের কারবার করছে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। কয়েক দফায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর এ সব অপরাধীরা নতুন নতুন কৌশলে কাজ করছেন। গোয়েন্দা সংস্থার একটি তথ্য বলছে, দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে অস্ত্র প্রবেশ করে রাজধানী ঢাকায়। বিশেষ করে বাস ও ট্রেনে করেই অস্ত্রগুলো আনা হয়।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, অস্ত্র বহনের কাজে পুরুষরা থাকলেও বর্তমানে এ সব বহনে ব্যবহার করা হচ্ছে নারীদের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীরা এ কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি এক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে আটকের পর রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে।
জানা যায়, প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রাজধানীতে ঢুকছে অবৈধ অস্ত্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন অস্ত্রের চোরাকারবারিরা। সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে অস্ত্র আনার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে নারীদের। সাধারণত গণপরিবহনে যাত্রীবেশে এ সব অবৈধ অস্ত্র নিয়ে আসেন চক্রের সদস্যরা। এরপর রাজধানীর বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
রাজধানীর পল্লবী এলাকা থেকে সম্প্রতি বিদেশি পিস্তলসহ মোহাম্মদ রুহুল আমিন ওরফে রিপন নামে একজনকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে ও মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এ সব তথ্য জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
পুলিশ বলছে, সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজধানীতে অবৈধ অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার জন্য সক্রিয় রয়েছে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে রাজধানীতে আনা হচ্ছে এ সব অবৈধ অস্ত্র। তবে গোয়েন্দা তথ্য এবং নজরদারির ভিত্তিতে অস্ত্র উদ্ধারে কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ। যখনই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তখনই অভিযানে নামছে পুলিশ।
গ্রেপ্তারকৃত রুহুল আমিন ওরফে রিপন জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানায়, এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ সব অস্ত্র দাম ৬০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা করে বিক্রি করেছেন তিনি। কাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছেন এ বিষয়ে বিস্তারিত না জানালেও বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন রিপন। এই চক্রের আরও দুই সদস্যের নাম জানিয়েছেন তিনি। পরিচয় শনাক্তের পাশাপাশি তাদের ধরতে তৎপর রয়েছে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তারকৃত রিপনের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা রয়েছে। অস্ত্র সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য তিনি। সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজধানীতে তার কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো অবৈধ অস্ত্র। পরে তিনি এগুলো বিক্রি করতেন। এ সব অবৈধ অস্ত্র দিয়েই রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাস, ছিনতাই, রাহাজানি চালিয়ে আসছে একটি চক্র। এ সব অস্ত্র কাদের হাতে গেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অস্ত্র আনা-নেওয়ার জন্য ক্যারিয়ার হিসেবে মেয়েদের ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের কী ধরনের প্রলোভনে ফেলা হতো, সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রিপন রাজধানীর মিরপুর-পল্লবী এলাকায় অস্ত্র বিক্রির জন্য নিয়োজিত ছিলেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিএমপির পল্লবী থানার এসআই সজিব খান বলেন, ‘বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে আমরা অস্ত্র ব্যবসায়ী রুহুল আমিন ওরফে রিপনকে গ্রেপ্তার করেছি। বিদেশি পিস্তলসহ তার কাছ থেকে ১২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী যাদের নাম এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে অভিযান চালানো হচ্ছে।’
পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি পারভেজ ইসলাম বলেন, ‘বিদেশি অস্ত্র কিংবা গুলি ক্রেতাদের চাহিদা মোতাবেক তারা সরবরাহ করতেন। রাজধানীতে এই চক্রের আরও যারা রয়েছেন, তাদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া যেসব রুট ব্যবহার করা হয়, সে সম্পর্কেও আমরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করছি।
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, স্থল ও জলপথের ৩০ রুটে দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র আনা হচ্ছে। অস্ত্রের সবচেয়ে বড় চালান ঢুকছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে। চট্টগ্রামের ৯টি রুট দিয়ে অস্ত্রের চালান আসছে। সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসার জন্য সন্ত্রাসীরা একাধিক রুট ব্যবহার করছে। যশোরের চৌগাছা, ঝিকরগাছা, শার্শা উপজেলার ২৪০ কিলোমিটারজুড়ে ভারতীয় সীমান্ত।
তথ্য বলছে, শার্শার বেনাপোল স্থলবন্দর, চৌগাছা উপজেলার শাহজাদপুর, হিজলা, আন্দুলিয়া, মান্দারতলা, বেনাপোলের সীমান্তের গোগা, কায়বা, শিকারপুর ও দৌলতপুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্রসহ বিভিন্ন চোরাচালান পণ্য দেশে ঢুকছে।
এদিকে আরেকটি তথ্য নিশ্চিত করে বলছে, সাতক্ষীরা সদরের কুশখালী ও গাজীপুর ঘাট দিয়ে সাধারণত চোরাচালান হয়ে অস্ত্র আসছে। বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার ভোলা নদী হয়ে এবং মোরেলগঞ্জ ও কচুয়া উপজেলা দিয়ে বলেশ্বরী নদীপথে অবৈধ অস্ত্র হাত বদল হয়। চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, দিনাজপুরের হিলি, কুড়িগ্রামের দুর্গাপুর ও নাগেশ্বরী, খাগড়াছরির দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গার বরকল ও বাঘাইছড়ি, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও নেত্রকোনার দুর্গাপুর দিয়ে অবৈধ অস্ত্র আসছে। সিলেটের তামাবিল ও কুমিল্লা সীমান্ত দিয়েও আসছে অবৈধ অস্ত্র।
অবৈধ ছোট আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে রয়েছে, ইতালির তৈরি ‘পেট্রো বেরেটা’, আমেরিকার ‘স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন’ স্পেনের ‘অ্যাস্ট্রা আনকেটা’র এবং ভারতের তৈরি পিস্তল ও রিভলবার। আছে অস্ট্রিয়ার গ্লোক পিস্তল-১৭, ভোলকেনিক ভলিশনাল রিপিটার, ওয়ালথার পিপি, পিপিকে/এস পিস্তল ও ফ্রান্সের বাউনিং হাইপাওয়ার সন্ত্রাসীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
এ ছাড়া আমেরিকার স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন ব্র্যান্ডের কয়েকটি মডেলের রিভলবার-পিস্তল এদেশের সন্ত্রাসীরা বর্তমানে বেশি ব্যবহার করছেন। এর বাইরে রয়েছে ভারতীয় পিস্তল ও রিভলবার।
সূত্র জানায়, পেট্রো বেরেটাসহ বিদেশি ওইসব অত্যাধুনিক অস্ত্রের মূল্য বৈধভাবে ৭০০ থেকে ১ হাজার মার্কিন ডলার। এ সব অস্ত্র বর্তমানে অবৈধভাবে কেনাবেচা হচ্ছে সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকায়। ছয় মাস আগেও বিক্রি হতো ৩ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকায়। ভারতীয় পিস্তল বেচাকেনা হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। মাস ছয়েক আগে ভারতীয় পিস্তলের দাম ছিল ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহ এড়াতে অস্ত্র চোরাকাচালানীরা মহিলাদের স্পর্শকাতর স্থানে বিশেষভাবে রেখে ক্রেতা-বিক্রেতার কাছে সরবরাহ করছে। এছাড়া পেঁপে ও তরমুজের মধ্যে অস্ত্র রেখে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়া হচ্ছে। এমনকি কাঁচা তরকারির গাড়ি, শিশুদের স্কুলব্যাগ, বাসের সিটের নিচসহ নানা কৌশলে অস্ত্র বহন করা হচ্ছে। অস্ত্র বহনের জন্য রয়েছে নারী ও পুরুষের বিশেষ সিন্ডিকেট।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিএমপি গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, আমরাও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের করতে তৎপর রয়েছে। তারা কৌশলে অস্ত্র ব্যবসা করে আর আমরা তাদের কৌশলে ধরার চেষ্টা করে থাকি।
তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় নানা তথ্য ও গোয়েন্দা নজরদারির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছি। যারাই অবৈধ অস্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিংবা অস্ত্র সরবরাহের সঙ্গে জড়িত, তারা বিষয়ে নজরদারিতে রয়েছে। এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অবৈধ অস্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে আমাদের কাজ চলমান রয়েছে।
কেএম/আরএ/