দৈনিক সাড়ে ১২ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি
ফের সক্রিয় ভিওআইপি সিন্ডিকেট, চট্টগ্রামে ৮২ লাখ টাকার সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার ১
চট্টগ্রাম নগরীর অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) ব্যবসায়ীকে বিপুল পরিমাণ সরঞ্জমাদিসহ গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তারকৃত ওই অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীর নাম নাছির উদ্দিন। গত ৮ মার্চ সন্ধ্যায় নগরীর পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুরে ইসমাইল টাওয়ারের পঞ্চমতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেন র্যাব-৭ হাটহাজারী ক্যাম্পের সদস্যরা। এ সময় তিন হাজার অনিবন্ধিত সিমসহ বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।
ওই ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার অতিরিক্ত এসপি মো. মাহফুজুর রহমান জানান, গ্রেপ্তার ব্যবসায়ী নাছির উদ্দিন ওই ফ্ল্যাটে বসবাস করলেও তার গ্রামের বাড়ি লোহাগাড়া উপজেলার ভবানীপুর বড় হাতিয়া গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের আব্দুল মোনাফের ছেলে। ওই ফ্ল্যাটে তিনি অবৈধ ভিওআইপি সরঞ্জমাদি নিজের হেফাজতে রেখে ২০১৬ সাল থেকে লাইসেন্সবিহীন অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা করে রাষ্ট্রের কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছে।
তিনি আরও বলেন, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, মেসেঞ্জার ইত্যাদি ওটিটির মতো উন্নত প্রযুক্তি এখন দেশে ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হলেও কমেনি ভিওআইপির মাধ্যমে সাধারণ ফোনে কল আদান-প্রদান। এর মধ্যে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন কোটি মিনিট কল এখনো ভিওআইপির অবৈধ কারবারিদের মাধ্যমেই আসছে। ফলে বিদেশ থেকে টেলিফোন কল আসা ও যাওয়ার পরিমাণ বাড়লেও কাঙ্খিত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ।
শুধু চট্টগ্রাম নয়, রাজধানীর বাইরেও এখন ভিওআইপি সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। রাজধানীতে এক সময় ভয়াবহ অবস্থা থাকলেও বর্তমানে এটি কমে এসেছে। তবে গোপনে এ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। চক্রটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজধানীর পার্শ্ববর্তী নারায়ানগঞ্জ, গাজিপুর, টঙ্গিসহ বিভিন্ন এলাকায় কার্যক্রম চালাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সম্প্রতি বিটিআরসি ও সহযোগী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ভিওআইপি কারবারিরা তাদের তৎপরতা শুরুর ব্যাপারে সতর্ক করে অভিযান চালানোর নির্দেশনা আসে। আর সেই নির্দেশনা মোতাবেকই এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ অভিযানের ধারা অব্যাহত থাকবে বলেও জানানো হয়।
ওই সভা থেকে বলা হয়, ঢাকা শহরের পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও এ কার্যক্রম চালাচ্ছে ভিওআইপি সিন্ডিকেট। সিম নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতার বাইরেও এক শ্রেণির চক্র সিম ব্যবহার করছে। বিশেষ করে টেলিটকের সিম ভিওআইপিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ঢাকার বাইরেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ ব্যাপারে সতর্ক ও অভিযান পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সূত্র মতে, দেশে অবৈধ ভিওআইপি কারবারে মোটা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অসাধু সিন্ডিকেট। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসি) অভিযানে ওই চক্রের মাঠপর্যায়ে থাকা কিছু কর্মী গ্রেপ্তার হলেও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। রহস্যজনক কারণে আইনের আওতায় আসছে না তারা। অথচ তারা অবৈধ ভিওআইপির কারবার করে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের অবৈধ কারবারে সরকার বছরে রাজস্ব হারাচ্ছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর ওসব টাকা যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে হুন্ডি, ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অবৈধ ভিওআইপির কারণে সরকারের দৈনিক কমপক্ষে সাড়ে ১২ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়। মাসে তার পরিমাণ ৩৭৫ কোটি টাকা। বার্ষিক হিসাবে ৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকারও বেশি। মোবাইল ফোন অপারেটরদের আন্তর্জাতিক কল অবৈধ ভিওআইপির কারণে উদ্বেগজনক হারে কমে গেছে। মূলত অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার মূলহোতারা প্রভাবশালী হওয়ায় বিটিআরসি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। অথচ ভিওআইপি শনাক্ত করার সব আধুনিক সরঞ্জাম বিটিআরসির রয়েছে। বিটিআরসি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে অবৈধ ভিওআইপি বন্ধ ও সরকারের রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব হতো।
আরও জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী সরকার প্রতি মিনিট ইনকামিং আইএসডি কলে ৩ সেন্ট হিসেবে রাজস্ব পাবে। ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে সার্ভিস প্রোভাইডারসহ বিভিন্ন তথ্যানুযায়ী দেশে দৈনিক ১০ কোটি মিনিটের বেশি বৈদেশিক কল রিসিভ হয়। আর তার প্রায় ৭ কোটি মিনিটই চোরাপথে বা ভিওআইপির মাধ্যমে আসছে। ফলে দৈনিক প্রায় ২০ কোটি টাকার বিদেশি কল ভিওআইপির মাধ্যমে চুরি হয়। যা বন্ধ করা গেলে সরকার দৈনিক সাড়ে ১২ কোটি টাকা আর বার্ষিক ৪ হাজার ৫৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হতো। অবৈধ ভিওআইপি কারবারের শীর্ষে রয়েছে সরকারি মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটর টেলিটক। অভিযোগ রয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির উচ্চপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশেই ভয়াবহ অবৈধ ভিওআইপি সিন্ডিকেট কার্যক্রম চালাচ্ছে। টেলিটকের কর্মকর্তাদের কেউ ওই চক্রের বাইরে গেলে তাদের চাকরিচ্যুতিসহ নির্যাতনেরও শিকার হতে হয়।
সূত্র আরও জানায়, অসাধু চক্রের অবৈধ ভিওআইপি কারবারে সরকারই শুধু রাজস্ব হারাচ্ছে না, লোকসান গুনছে বৈধভাবে দেশে ফোন কল প্রবেশের ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোও। লোকসান গুনতে গুনতে ওসব প্রতিষ্ঠান প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। অবৈধ ভিওআইপি কারবারের মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা না গেলে টেলিকম খাতের বহু প্রতিষ্ঠান অচিরেই ধ্বংসের মুখে পড়বে। তাতে সরকার রাজস্ববঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি বৈধ বহু ব্যবসায়ীকেও ব্যবসা বন্ধ করে পথে বসতে হবে।
এদিকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার বিষয়ে একাধিক অভিযোগ জমা হয়েছে। ওসব অভিযোগের বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গণমাধ্যমকে জানান, কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওসব অভিযোগ আমলযোগ্য হলে প্রশাসনিক তদন্ত ও অন্য যেসব করণীয় তা অবশ্যই করা হবে।
এদিকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় হুইপ ও সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ গত সংসদ অধিবেশনে ভিওআইপি কারবারি প্রসঙ্গে কথা বলেন।
তিনি বলেন, বৈধ ভিওআইপি ব্যবসার কারণে বাংলাদেশ বছরে ৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে উল্লেখ করে বাংলাদেশে অবৈধ ভিওআইপির ভয়াবহ সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে বাংলাদেশের সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বিটিআরসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাই বলছেন, ভিওআইপির কারণে সরকারের দৈনিক ক্ষতি হয় সাড়ে ১২ কোটি টাকা। মাসে এই ক্ষতির পরিমাণ ৩৭৫ কোটি টাকা। বার্ষিক হিসাবে ৪,৫৬২ কোটি টাকার বেশি। আশ্চর্যজনকভাবে এই ভিওআইপির সাথে জড়িত হয়ে গেছে আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠান টেলিটক। টেলিকট কীভাবে জড়িত হলো?
তিনি বলেন, রাজধানীর নিউমার্কেট-তুরাগ-শাহআলী থানা এলাকায় বিটিআরসির এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড ইন্সপেকশন ডিরেক্টরের পরিদর্শকদের সমন্বয়ে এবং র্যাব মিলে তারা একটি অভিযানে গিয়েছিল। সেই অভিযানে গিয়ে তারা ভিওআইপির চক্রের কয়েকজনকে আটক করেন। সেখানে ব্যবহৃত যে মোবাইলের সিম পাওয়া যায়, সেই সিম হচ্ছে টেলিটকের, ৩,৪০০টি সিম। পরবর্তীতে বিটিআরসি টেলিটকে পরিদর্শনে গেছে, তারা তদন্তে গেছে। তদন্তে শেষে বিটিআরসি একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনে বিটিআরসি বলেছে, অবৈধ ব্যবহৃত সিমগুলো একই ব্যক্তির একটি এনআইডির অনুকূলে কেনা এবং একই সেলপয়েন্ট থেকে বিক্রি হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, কিছু কর্মকর্তা এবং তাদের সাথে কিছু রাজনৈতিক প্রভাবশালী চক্র মিলে টেলিটককে এই অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সাথে জড়িত করেছেন। এইসব কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক চক্রই অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় জড়িত।
কেএম/এএস