৪৭ বছরে পদার্পণ ডিএমপির
১৯৭৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মাত্র ১২টি থানা এবং সাড়ে ৬ হাজার জনবল নিয়ে গঠিত হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। পহেলা ফেব্রুয়ারি গঠিত হলেও যাত্রা শুরু করে ২৬ ফেব্রুয়ারি। এরপর একে একে কেটে গেছে ৪৬ বছর। ৪৭ বছরে পদার্পণ করেছে ডিএমপি। ১২টি থানা এখন ৫০টিতে এবং সাড়ে ৬ হাজার জনবল এখন ৩১ হাজার ৬৬ জনে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে কাজের পরিধি বেশি হওয়ায় বাংলাদেশ পুলিশের অন্যান্য ইউনিটের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক সুযাগ-সুবিধা দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ডিএমপিকে।
এরপরও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সেবার মান নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। অনেকের দাবি, এখনও পুরোপুরি জনবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি পুলিশের এ ইউনিট। তবে এসব আলোচনা-সমালোচনা নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, অধিক জনশক্তি হওয়ার কারণে হয়তো কিছুটা সমালোচনা হতে পারে। তারপরও সব ভুল শুধরে এগিয়ে যাচ্ছে ডিএমপি।
বর্তমানে থানা, জনবল ও সুযাগ-সুবিধা বহুগুণে বৃদ্ধি পেলেও নাগরিক প্রত্যাশা পূরণে ঘাটতি রয়ে গেছে। এখনও পুরোপুরি জনবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি ডিএমপির থানাগুলো। তাদের দাবি, অনেক সময় সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে প্রায়ই হয়রানি, মামলা না নেওয়া, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো ও তদন্ত ভিন্নখাতে প্রবাহিত করাসহ নানান অভিযাগ রয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও পেশাগত জ্ঞানার্জনকে প্রাধান্য দিয়ে সৃজনশীল ও জন অংশিদারিত্বকে অন্যতম কার্যকৌশল হিসেবে গ্রহণ করে ইতিমধ্যে জনগণের সেবক হয়ে উঠেছে ডিএমপি।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাবি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে অপরাধের ধরন। সেগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিএমপিও হয়েছে সময়োপযোগী ও আধুনিক। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, অপরাধী শনাক্ত ও নাগরিকদের নিরাপত্তার পাশাপাশি গত প্রায় আড়াই বছর ধরে বিশ্বজুড়ে মহামারি আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসের সময়েও সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছেন ডিএমপির প্রতিটা সদস্য।
এদিকে প্রতিষ্ঠাকালে ডিএমপিতে ছিল না আধুনিকতার ছোঁয়া। কিন্তু আধুনিকায়নের যুগে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে এই রাজধানী জনবহুল শহরে পরিণত হয়েছে। বেড়েছে অপরাধের ধরণ। এসব মোকাবেলা এবং প্রতিরোধে পর্যায়ক্রমে গঠন করা হয়েছে পুলিশের নতুন নতুন ইউনিট। কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি), সাইবার ক্রাইম ইউনিট, সোয়াট, বোম ডিসপোজাল ইউনিট, ডগ স্কোয়াটসহ বেশ কয়েকটি ইউনিট। এর পাশাপাশি বেড়েছে ডিএমপির আধুনিক সেবার মান। ইচ্ছা করলে এখন যে কেউ বাসায় বসে অনলাইনে জিডি করতে পারেন। একই সঙ্গে ঘরে বসেই পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য আবেদন করতে পারেন। মাত্র ৩ দিনে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছেন নগরবাসী।
অপরাধী শনাক্ত, নাগরিক ডাটাবেস ও নারী-শিশুদের সেবার ক্ষেত্রেও তৎপর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। তারা এখন অপরাধী শনাক্ত ও নাগরিক ডাটাবেস সংরক্ষণ করে। নারী ও শিশুদের সেবার লক্ষ্যে ডিএমপির থানাগুলোতে যুক্ত করা হয়েছে নারী ও শিশু হেল্প ডেক্স। ভুক্তভোগী কোনো নারীকে বা শিশু সেবার জন্য থানায় গেলে সেখানে নারী পুলিশ সদস্যরা সেবা দিয়ে থাকেন। ভুক্তভোগী যেকোনো পরিবেশ এবং পরিস্থিতিতে নারী পুলিশ সদস্যের কাছে সব শেয়ার করতে পারেন।
একইভাবে তেজগাঁও থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে করা হয়েছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। সেখানে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের সেবা দেওয়া হয়। কুড়িয়ে পাওয়া কিংবা হারিয়ে যাওয়া শিশু, নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের সেখানে রেখে আইনি সহায়তা, চিকিৎসা দেওয়া, কাউন্সিলিংসহ সব ধরনের সেবা দিচ্ছে ডিএমপির এই বিশেষ ইউনিট।
ডিএমপির কর্মকর্তারা বলছেন, মেট্রোপলিটন পুলিশকে একটি যুগোপযোগী, দক্ষ ও জনবান্ধব বাহিনীতে উন্নীত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মাদক, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় ডিএমপির সাফল্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কমিউনিটি পুলিশিং, বিট পুলিশিং ও উঠান বৈঠকের মতো সময় সময়োপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে দক্ষ জনবল, আধুনিকায়ন ও অনেক কার্যক্রম সহজ করা হলেও এখনো পুরোপুরি জনবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি থানা পুলিশ।
অন্যদিকে ডিএমপির ৪৭ বছরে এসেও নাগরিক সেবা দেওয়া নিয়ে প্রায়ই অভিযোগ উঠেছে ডিএমপির সদস্যদের বিরুদ্ধে। থানায় মামলা কিংবা জিডি দায়ের করতে গেলে না নেওয়া, মামলা নিলেও তদন্ত ও চার্জশিট ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা, একপক্ষের হয়ে
কাজ করা, মাদক দিয়ে ফাঁসানো কিংবা চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পেয়ে মাদক মামলায় ফাঁসানো, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ উঠছে প্রায়ই। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গত আড়াই বছরে এসআই থেকে পরিদর্শক পদমর্যাদার প্রায় শতাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, নগরবাসীর যতটা প্রত্যাশা ছিল, আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও হয়তো সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। তবে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
তিনি আরোও জানান, অপরাধ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং মামলা নিতেই সরকার আমাদের বেতন-ভাতা দিচ্ছেন। কেউ মিথ্যা মামলা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগও রয়েছে। তবে মামলা নিতেই হবে। থানা পুলিশের একটি কালচার হয়ে গেছে ডাকাতি-ছিনতাই মামলা নিতে চায় না। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। থানায় মামলা বা সেবা নিতে গেছেন এমন ১ লাখ ৮০ হাজার জনকে ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্স থেকে কল করা হয়েছে।
তিনি বলেন, যারা সেবা পাননি এবং এক্ষেত্রে যেসব অফিসার জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠার ৪৭ বছরে এসেও সরকারি নয় এখনো ভাড়া ভবনে চলছে ডিএমপির ১৬ থানার কার্যক্রম। এতে নাগরিক সেবা কিছুটা হলেও
ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন নগরবাসী।
ডিএমপির স্টেট বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ডিএমপির হাতিরঝিল থানা, শিল্পাঞ্চল, ওয়ারী, কলাবাগান, বংশাল, কদমতলী, কামরাঙ্গীরচর, খিলগাঁও, রামপুরা, রমনা, মুগদা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, তুরাগ ও আদাবর থানার কার্যক্রম চলছে ভাড়া ভবনে। এর মধ্যে শিগগিরই নিজ ঠিকানা পাবে ৭টি থানা।
প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বিকালে ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স পর্যন্ত বর্ণাঢ্য র্যালির আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর ডকুমেন্টারি প্রদর্শনসহ মনাজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ উপলক্ষে প্রত্যেক বছরের মতো এবারও নানা আয়োজন, কর্মসূচি ও নাগরিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এবারের প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপন করবে পুলিশের এই ইউনিট। এ কারণে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে নাগরিক সম্মিলনের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এ ছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন ও বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ।
এসআইএইচ