ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে ৫ মাসে অর্ধ কোটি টাকা আত্মসাৎ
‘শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে প্রতারণার মাধ্যমে অর্ধ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন ফয়েজ উল্লাহ। ফুটপাতের বিক্রেতা, হকার, রিকশা ও ভ্যানচালক এমনকি ভিক্ষুকসহ শ্রমজীবীদের টার্গেট করে গত ৫ মাসে কোম্পানির ৩০০ সদস্যের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে ৫০ লাখের বেশি টাকা হাতিয়ে নেন এই প্রতারক।
মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।
এর আগে সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাত থেকে ভোর পর্যন্ত রাজধানীর মিরপুরের শাহ আলী থানাধীন মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সে অভিযান চালিয়ে প্রতারক ফয়েজ উল্লাহসহ তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৪।
গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন— মুন্সীগঞ্জ জেলার আফরিন আক্তার (২৪) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোছা. তাসলিমা বেগম (৩৩)।
র্যাব জানায়, এসএসসি পাস ফয়েজ উল্লাহ ১৯৯২ সালে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় আসেন। মিরপুরের ১৪ নম্বরে শুরু করেন কনস্ট্রাকশনের কাজ। এরপর ২০০৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কাফরুলের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ফিল্ড অফিসার পদে চাকরি করেন তিনি। গত ২০২১ সালে ‘শিবপুর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এই সমিতির নাম বেআইনিভাবে পরিবর্তন করে ‘শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামে শুরু করেন প্রতারণা।
এই ভুয়া সমিতির সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ নিজেই। সাধারণ সম্পাদক তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম। সমিতির সহ-সভাপতি ছিলেন তার বন্ধু সিরাজুল ইসলাম, যুগ্ম সম্পাদক তার শ্যালক আলাউদ্দিন, কোষাধ্যক্ষ ছেলে আরিফ হোসেন এবং তার আরও এক বন্ধু মো. জামিল হোসেন ওয়াদুদ ছিলেন সদস্য।
ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, ভুক্তভোগীদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে শাহ আলী থানাধীন মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সে অভিযান চালিয়ে শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের সভাপতি ফয়েজ উল্লাহসহ মোট ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে সেখান থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত ফরম, ঋণ গ্রহীতার ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের জীবন বৃত্তান্ত, লিফলেট, সিলসহ বিভিন্ন কাগজপত্র এবং ফয়েজ উল্লাহর নামে কমিউনিটি ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির নানা সার্টিফিকেট, চেক বই, মনিটর, সিপিইউ উদ্ধার করা হয়।
মোজাম্মেল হক আরও বলেন, শিবপুর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি লিমিটেডের নাম পরিবর্তন করে তৈরি করা ভুয়া সমিতিতে ২০ জন সদস্য অন্তর্ভুক্তির কথা উল্লেখ থাকলেও বর্তমানে ৩০০ জন সদস্য রয়েছে। এছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানের কোনো রক্ষিত জামানত নেই।
অতিরিক্ত ডিআইজি আরও বলেন, প্রতারণার কৌশল হিসেব সদস্য সংগ্রহ করা হতো। এই চক্র মাঠ পর্যায়ের কর্মী অথবা সদস্যদের মাধ্যমে রাজধানীর মিরপুরের বিভিন্ন বস্তি এলাকার প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক, সেলুনের কর্মচারী, মনিহারি ও ফুটপাতের দোকানদার, গৃহকর্মী ও নিম্ন আয়ের মানুষদের টার্গেট করে ঋণের লোভ দেখিয়ে সঞ্চয়ের নামে তাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ ও ডিপিএস করতে উদ্বুদ্ধ করতো। পরে তারা ভুক্তভোগীদের প্রলুব্ধ ও বিভিন্ন তথ্যাদি সংগ্রহ করে নানান কৌশলে ভুলিয়ে প্রতারক চক্রের অফিস কার্যালয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতো। ‘শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ প্রতিদিন আনুমানিক ৩০০ জন গ্রাহকের কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করে। পরে শ্রমজীবী মানুষদের ভুল বুঝিয়ে ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকল্প প্রচার করে যেমন—মুদারাবা ডিপোজিট স্কিম, মুদারাবা কোটিপতি বিশেষ সঞ্চয়, মুদারাবা লাখপতি ডিপোজিট স্কিম, মুদারাবা মিলিওনিয়ার ডিপোজিট স্কিম, মুদারাবা পেনশন ডিপোজিট।
তিনি আরও বলেন, প্রতারক ফয়েজ উল্লাহ ভুক্তভোগীদের বিভিন্নভাবে অল্প সময়ে ঋণ দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে সঞ্চয়/বিনিয়োগ/ডিপিএস করতে আগ্রহী করতো। ভুক্তভোগীদের বলা হতো ১০-১৫ দিন ঠিকমতো নির্দিষ্ট হারে সঞ্চয় দিলে তাদের ঋণ দেওয়া হবে, যা দিয়ে তারা সুন্দরভাবে ব্যবসা করতে পারবেন। ভুক্তভোগীদের দুই-একজনকে ঋণ দিলেও কেউ সঞ্চয় থেকে ঋণ পেতেন না।
এই কোম্পানির কিছু সদস্য দৈনিক ভিত্তিতে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে সঞ্চয়/ডিপিএসের টাকা সংগ্রহ করতেন। ভুক্তভোগীদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখানো হতো, তারা যদি সময়মত সঞ্চয়/ডিপিএসের টাকা না পরিশোধ করেন তাহলে তাদের সঠিক সময়ে ঋণ দেওয়া হবে না। অথবা মেয়াদ শেষে তারা মুনাফা কম পাবেন এবং জরিমানাও করা হবে।
প্রতারক চক্রটি ফ্ল্যাট ও জমি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েও দীর্ঘদিন ধরে এমন প্রতারণামূলক কাজ করে আসছিলে বলে জানিয়ে র্যাব কর্মকর্তা বলেন, প্রতারণার আর একটি কৌশল হিসেবে ভুক্তভোগীদের বোঝানো হতো যে, দৈনিক মাত্র ২০০-৩০০ টাকা করে জমা করলে একসময় ঢাকা শহরে তাদের একটি করে ফ্ল্যাট বা জমি দেওয়া হবে। এছাড়াও প্রতারক চক্রটি শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড এবং ভুয়া ও অনুমোদনবিহীন মাইসার ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশনকে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বলে মিথ্যা আশ্বাস দিত।
কেএম/আরএ