‘কিসের টিকিট, গাড়ি চলে চুক্তিতে’
সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। এই সর্বনিম্ন ভাড়ার দূরত্ব ২ দশমিক ০২ কিলোমিটার। এরপর থেকে প্রতি কিলোমিটারে যাত্রী ভাড়া বাড়ে। কিন্তু সাভার থেকে কমলাপুর হয়ে খিলগাঁও পর্যন্ত চলাচলকারী বাহন পরিবহন নির্দিষ্ট দূরত্বের বেশি ভাড়া আদায় করছে। শাহবাগ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার পথের ভাড়া আদায় করছে ১৫ টাকা। অথচ ৪ দশমিক ০৭ কিলোমিটারের ভাড়া হচ্ছে মাত্র ১২ টাকা। অর্থাৎ যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
যাত্রীদের অভিযোগ ই-টিকিটিং চালু করার পর থেকেই এভাবে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার (২১ মার্চ) সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বিভিন্ন গণপরিবহনে চড়ে যাত্রী ও পরিবহন কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ই-টিকিটিংয়ে বেশি ভাড়া আদায়, পজ মেশিন বিকল থাকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নানান অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্বাধীন পরিবহনের যাত্রী হাসান বলেন, ‘মোহাম্মদপুর থেকে ফার্মগেটের দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। অথচ ভাড়া নিচ্ছে ইচ্ছামতো। টিকিট দিলে এত নিতে পারত না। কিসের টিকিট দেবে। বলে, মেশিন নষ্ট। চুক্তিতে চলছি। খরচা বাদে যা থাকে তাই মহাজনকে দেওয়া হয়।’
সালাম নামে এক যাত্রী বলেন, ঠাসাঠাসিতে উঠা যায় না। তাই টিকিট দেয় না। যখন যাত্রী একেবারে কম তখন টিকিট দেয়।
ফার্মগেটে দেখা গেছে, কন্ট্রাক্টর টিকিট ছাড়াই যাত্রীদের কাছে ভাড়া নিচ্ছে। অনেকে হইচই করলেও তার সাফ জবাব, টিকিট দিয়ে কী করবেন। শুধু তাই নয়, যাত্রীরা নামতে চাইলেও চালক থামে না। এর মধ্যেই যাত্রীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নামছে। অনেকে চিৎকার করে বলে, ড্রাইভার গাড়ি চাপাও। নাইমা লই। এভাবেই চলছে স্বাধীনের বেপরোয়া যাত্রীসেবা।
একই পরিবহনে (ঢাকা মেট্রো ব ১১-৯০০৯) ফার্মগেট-বসিলা রোড দেখিয়ে ১৪ টাকা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। অথচ গাড়ি কখনোই মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পার হয় না। এভাবে বেশি দূরত্ব দেখিয়ে গ্রাহকের কাছে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
আসাদগেট থেকে প্রজাপতি পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো ব ১৬-০৩৩০) গাড়িতে চড়া যাত্রী খুরশেদ আলম বলেন, ভাড়ার বিপরীতে টিকিট চাইলে গাড়ির কন্ট্রাক্টর মনির বলেন, টিকিট দিয়ে কী করবেন। মেশিন নষ্ট। তা ছাড়া চুক্তিতে মালিক গাড়ি দিয়েছে। মোহাম্মদপুর থেকে বসিলার ভাড়া ১২ টাকা। দূরত্ব কত কিলোমিটার জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা জানি না। মোহাম্মদপুরে কোনো স্টপেজ নেই। ময়ুরভিলা থেকে বসিলা ১০ টাকা। উইঠ্যা নামলেই ১০ টাকা দিতে হবে।’
কন্ট্রাক্টর এত কথা বললেও চালক রবিউল বলেন, তেল খরচ, লাইনের খরচ বাদ দিয়ে মালিককে প্রতি ট্রিপে ৩ হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়। পজ মেশিনে যা টিকিট কাটা হয় তাতে ১৫ শতাংশ দিতে হয়। তাই সব টিকিট কাটা হয় না। শুধু আমারটা না, সব গাড়ি চুক্তিতে দেওয়া। যাতায়াতে তেল লাগে ১৩০০ টাকার, লাইনে লাগে ৮০০ টাকা। এ ছাড়া ড্রাইভার-কন্ট্রাক্টরের খাবার নাস্তা তো আছে। কিছু থাকে না। ওভারলোড করে যাত্রী নিয়েই তা পুষিয়ে নিই। কিলোতে আড়াই টাকা ভাড়া হয়েছে। কিন্তু তেলের দামতো কমায়নি।
শুধু এই বেসরকারি পরিবহনেই নয়, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের উদ্যোগে ঘাটারচর থেকে চিটাগং রোডে ঢাকা নগর পরিবহন চালু করার পর ডেমরা পর্যন্তও এই নগর পরিবহন চালু করা হয়েছে। প্রথমে কাউন্টার সিস্টেম চালু করা হলেও বর্তমানে তার বালাই নেই। ঘাটারচর থেকে ফার্মগেট হয়ে ডেমরা পর্যন্ত হানিফ পরিবহনের এই গাড়ির নির্দিষ্ট কোনো স্টপেজ নেই। লোকাল গাড়ির মতো যেখানে-সেখানে যাত্রী উঠানামা করছে। শুধু তাই নয়, যাত্রীদের টিকিটও দেওয়া হচ্ছে না। নতুন যাত্রীদের পেলে কন্ট্রাক্টররা বেশি করে করে ভাড়া আদায় করছে বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।
বিকাশ পরিবহনে বিমানবন্দর থেকে আসাদগেট পর্যন্ত ৪০ টাকা জানিয়ে ভাড়া নিয়েছে। যাত্রী রফিক বলেন, টিকিট কোথায় বলা মাত্র ৩৮ টাকার টিকিট ধরিয়ে দেয়। সরকার নির্ধারিত দূরত্ব অনুযায়ী এই ভাড়া কি না জানতে চাইলে (ঢাকা মেট্রো ব ১৩-৬৭৮৫) গাড়ির কন্ট্রাক্টর জসিম বলেন, আমরা জানি না। মেশিন দিয়েছে যে তারা জানে।
এসময় আলাউদ্দিন নামে এক যাত্রী বলেন, আমি ক্যান্টনমেন্টে উঠে আসাদগেটে নেমেছি। আমার কাছ থেকেও ৪০ টাকা ভাড়া নিয়েছে। এটা অনেক বেশি। টিকিট চাইলে বলে মেশিনে ঝামেলা।
রাজধানীর গণপরিবহনে নৈরাজ্য ঠেকাতে পরিবহন মালিকরা বিভিন্ন রুটে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করেছে। কিন্তু এর কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। বরং যে যেভাবে পারছে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছে। যাত্রীরা টিকিট চাইলেও টিকিট পান না। প্রজাপতি, পরিস্থান, স্বাধীন, তরঙ্গসহ বিভিন্ন কোম্পানির পরিবহনের কন্ট্রাক্টরদের হাতে বা পকেটে পজ মেশিন থাকলেও তারা বলছেন, মেশিন নষ্ট, নেট নেই। কেউবা বলছেন, মালিক পাসওয়ার্ড দেয়নি। মেশিনের সমস্যা। তাই টিকিট ও ভাড়া নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে যাত্রীদের হইচই, চিৎকার, চেঁচামেচি, এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও দেখা গেছে।
ই-টিকিটিং নিয়ে এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ এই প্রতিবেদককে-কে বলেন, ব্যস্ত আছি। এখন কথা বলা সম্ভব নয়। শুধু বলেন, ঢাকায় প্রায় সব গণপরিবহনে ই-টিকিটিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তা মনিটরিং করা হচ্ছে।
এনএইচবি/এসজি