সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নজরদারিতে কাউন্সিলররা
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে নজরদারিতে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে— নজরদারিতে থাকা এ সব ওয়ার্ড কাউন্সিলর সরকার বিরোধী তৎপরতায় যুক্ত রয়েছেন। সরকারবিরোধী যেসব সভা-সমাবেশ হচ্ছে সেগুলোতে জনবল সরবরাহ করছেন। এমনকি এদের কেউ কেউ বিরোধী পক্ষের অনেক নেতার সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করছেন। এমন তথ্যের ভিত্তিতেই সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাউন্সিলরদের কর্মকাণ্ড ও তৎপরতা নজরদারিতে রেখেছে। একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে সেগুলোও খতিয়ে দেখছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে থাকবেন ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের এ সব কাউন্সিলরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাউন্সিলরদের অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে চলতি বছরের শুরু থেকেই তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত দুই সিটির কাউন্সিলররা বিশেষ নজরদারিতে থাকবে। যাতে করে তারা সরকারি কাজে বাধা বা লোভে পড়ে সরকার বিরোধী কোনো চক্রান্তে লিপ্ত হতে না পারে। এ ছাড়া যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের সত্যতা পাওয়া যাবে তাদের বিষয়ে সরকারিভাবে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশনা রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই সিটির অনেক কাউন্সিলর প্রশ্নের মুখোমুখি। অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততারও অভিযোগ রয়েছে। সব কিছু আমলে নিয়েই আমরা কাজ করছি।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে বেশ কয়েকজন কাউন্সিলরের বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন সরকারি দপ্তরে জমা দেওয়া হয়। এদের পাশাপাশি এবার নতুন করে বেশ কিছু কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেসব অভিযোগ আমলে নিয়েই মূলত তাদের উপর নজরদারি করা হচ্ছে ও তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে তাদের অতীতের কর্মকাণ্ড ও বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে মাঠে জোরালোভাবে নেমেছে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা ইউনিট।
গোয়েন্দারা বলেছেন, ঢাকার কাউন্সিলরদের অতীতের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে তৈরি করা হচ্ছে গোপন নথিপত্র। আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের গতিবিধির ওপর নজর রেখে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কেউ অপরাধী হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনাও রয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, অভিযোগ আছে অনেক কাউন্সিলর বিশেষ করে বর্তমান সময়ে বিরোধী দলের আন্দোলন কর্মসূচিতে লোক সমাগমের জন্য গোপনে তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ বা কৌশলগত ভূমিকা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে। এজন্য কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের তথ্য সংগ্রহ করছেন গোয়েন্দারা।
তথ্য বলছে, সরকার বিরোধী তৎপরতার বাইরেও দুই সিটির অনেক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, জায়গা-জমি দখল, জুয়ার আসর পরিচালনা, কিশোর গ্যাং, মাদকদ্রব্য সেবন ও বিক্রির জন্য দূর থেকে সহযোগিতা করাসহ অনেক অভিযোগ উঠে এসেছে।
সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার দুই সিটির বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারেন। তারা বিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের বড় বড় সমাবেশে টাকার বিনিময়ে চুপিসারে নিজ নিজ এলাকা থেকে লোক পাঠিয়েছেন। দ্বাদশ সংবাদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা বিরোধীদলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। তাদের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টায় আছেন।
গোয়েন্দারা বলছে, এ সব কাউন্সিলররা সরকার বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চিন্তা করছে কি না? সেসব বিষয়ে মূলত তদন্তের জন্য সরকারের উপর মহল থেকে নির্দেশনা রয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, যেসব কাউন্সিলর নজরদারির তালিকায় রয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ডিএনসিসি ২৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরিদুর রহমান খান ইরান। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে ফার্মগেট এলাকায় দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কোচিং বাণিজ্য সবকিছুই তার একক নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ভয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলেন না।
অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ফরিদুর রহমান ইরান বলেছেন, এসব আমার বিরুদ্ধে এক ধরনের ঢালাও অভিযোগ করা হচ্ছে। এ সব মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়।
ডিএনসিসির ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ সলুর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ২৪টির বেশি মামলা আছে। তাকেও কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
গোয়েন্দা নজরদারিতে আছেন ঢাকা দক্ষিণের ৫৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আকাশ কুমার ভৌমিক। কদমতলী থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তিনি। সবজি বিক্রেতা থেকে কাউন্সিলর হয়ে উঠা আকাশের বিরুদ্ধে ভূমি দখল, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসায়ে যুক্ত থাকার অভিযোগ আছে। তার কর্মকাণ্ডে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ক্ষুব্ধ।
৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেনের ওপর এলাকায় কেউ কথা বলার সাহস পায় না। এলাকাবাসীর অভিযোগ, কাউন্সিলর হোসেনের বাইরে কেউ কথা বললেই তার ওপর নির্যাতন নেমে আসে। এলাকায় মাদক বিক্রি, বাড়ি দখল, চাঁদাবাজি সবকিছুই তার নিয়ন্ত্রণে।
এলাকায় ‘ম্যাজিক রতন’ হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ সিটির ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ রতন। গুলিস্তান এলাকায় তার একক আধিপত্য। তিনি যুবলীগ নেতা সম্রাটের বন্ধু। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাব থেকে ক্যাসিনোর বড় একটি অংশের ভাগিদার ছিলেন এই রতন। সিটি করপোরেশনের কয়েকটি মার্কেটে দখল, চাঁদাবাজিসহ বহু অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। বর্তমানে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে রয়েছেন তিনি।
অবশ্য কাউন্সিলর রতন সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি নিজেই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে। উল্টো আমাকে এ সব বলা হচ্ছে কেনো? আমার বিরুদ্ধে এ সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। গোয়েন্দা সংস্থা সঠিক তদন্ত করুক আমার কোনো সমস্যা নেই।
নজরদারিতে থাকা উত্তর সিটির ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনিসুর রহমান নাঈমের বিরুদ্ধেও মসজিদ কমপ্লেক্স, ফুটপাত, রাস্তা, সাইনবোর্ড, খাসজমি ও সাধারণ মানুষের জমি দখলসহ রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। রাজধানীর বিমানবন্দর, কাওলা, শিয়ালডাঙ্গা ও গাওয়াইরসহ আশেপাশের এলাকায় দখল ও চাঁদাবাজির জন্য রয়েছে নাঈমের নিজস্ব বাহিনী।
একই সিটি করপোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম মানিকের বিরুদ্ধে ধর্ষণসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তিনি এলাকায় মার্কেট করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
নজরদারিতে রয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলহাজ্ব হাসিবুর রহমান মানিক। উত্তর সিটির ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জামাল মোস্তফাও। উত্তরের ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আফসার উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে রাজউকের ও ব্যাক্তি মালিকানাধীন প্লটে মার্কেট বানানো, দখলবাজি, ফুটপাত ও পরিবহন চাঁদাবাজিসহ জুয়া ও ক্যাসিনো কারবার থেকে প্রতিমাসে মোটা অংকের টাকা তোলার অভিযোগ রয়েছে। ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম শফিক। উত্তরাতে সে গোল্ডেন শফি নামে সবার কাছে পরিচিত। তিনি উত্তরখান থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।
গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকা উত্তর সিটির ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পি এলাকায় অঘোষিত রাজা। রূপনগরের ঝিলপাড় বস্তি থেকে অবৈধ গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ও ডিশলাইন থেকে মাসে আয় হয় অন্তত দুই কোটি টাকারও বেশি। তাকে ঢাকার সবচেয়ে ক্ষমতাধর কাউন্সিলর বলা হয়। সে মাঝে মাঝে পুলিশের উপর হামলা করে এবং একবার থানার মধ্যে বোমা রেখে হামলার পরিকল্পনা করে বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া রূপনগর ও আশেপাশের এলাকার পরিবহন থেকে চাঁদা তোলা ও মাদক কারবারিদের সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অল্প সময়ে এত সম্পদের নেপথ্যে রয়েছে তার দখলদারিত্ব আর চাঁদাবাজি।
অবশ্য তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পি বলছেন, এ সব অভিযোগ সঠিক নয়। আমার বিরুদ্ধে একটি চক্র বরাবর কুৎসা রটানোর চেষ্টায় আছে।
এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার শনিবার (৭ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, যে কোনো অপরাধ বেড়ে গেলে পুলিশ সেটাকে গোপন তদন্ত করে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। আর যদি যে কোনো দায়িত্বরত ব্যক্তি বা ঢাকা সিটির কাউন্সিলদের অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের তদন্তের দরকার হয় বা সরকারিভাবে প্রয়োজন হয় তাহলে সেই তদন্ত আমাদের পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ করে থাকে। তবে এটা একান্তই দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের বিষয়।
এনএইচবি/আরএ/