চাঁদার দ্বন্দ্বেই উত্তরায় বারে অভিযান!
সারাদেশে দেশি ও বিদেশি মদ বিক্রির ৫০৬টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে ১৪৭ প্রতিষ্ঠানের আছে ১৮৯টি বার। ডিএনসির তথ্যমতে, দেশি মদ বিক্রি করছে ৩১৭টি প্রতিষ্ঠান।
দেশে মদের বারের লাইসেন্স দেওয়া, মদ খাওয়ার অনুমতি দেওয়া থেকে শুরু করে সব বিষয় দেখভাল করার দায়িত্ব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের।
বারমালিকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা ভ্যাট কর্মকর্তারাও অভিযান চালাবে না।
বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) রাত ও শুক্রবার (৭ অক্টোবর) দিবাগত রাতে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত কিংফিশার নামে একটি বারে অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরা বিভাগ। অভিযানে কথিত বারটি থেকে ৫০০ বোতল বিদেশি মদ ও ছয় হাজার ক্যান বিয়ার জব্দসহ ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি গোয়েন্দা পুলিশ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাঠ পর্যায়ের একটি তথ্য বলছে, অধিকাংশ বার থেকে মাসিক চাঁদা আদায় করেন ডিএনসির কিছু কর্মকর্তারা। পুলিশ চাঁদা না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে মূলত উত্তরার বারে অভিযানে নামে।
রবিবার (৯ অক্টোবর) কথিত বারে পুলিশের অভিযান ঠিক হয়নি বলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এসব অভিযোগ করেছেন। তাদের দাবি, বারের অনুমোদন এবং সঠিক কাগজ পত্রের বিষয়টি আমরা দেখি এটি পুলিশের বিষয় না। আমরা র্যাব-পুলিশকে জানালে তারা আমাদের সহযোগিতা করবে এটাই আছে আমাদের আইনে।
একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন বার থেকে একচ্ছত্র মাসিক চাঁদা আদায় করে ডিএনসির কিছু কর্মকর্তা।
সেখানে পুলিশ সদস্যরা তেমন গুরুত্ব পান না। এ কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে ডিবি অভিযান চালানো শুরু করে। মূলত সরকারি দুই সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বে ওই বারে অভিযান পরিচালনা হয়।
গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, যেকোনো জায়গায় অভিযান চালাতে পারে পুলিশ। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, কোনো অভিযানের সময় আমাদের জানানো উচিত বা আমাদের কাছে তথ্য জানা উচিত ছিল পুলিশের। তাদের দাবি, কথিত বারে পুলিশের অভিযান ঠিক হয়নি।
লেকভিউ বারে গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যাতায়াত ছিল। এ নিয়ে সম্প্রতি একটি ঝামেলা তৈরি হয়। সেই ঝামেলার ধারাবাহিকতায় অভিযান চালানো হয়েছে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, ‘সেখানে কাদের যাতায়াত ছিল সে বিষয়ে আমরা তদন্ত করব।’
এর আগে ২০১৯ সালের ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের সময় থেকে মদের বারগুলোতে একের পর এক অভিযান চলে আসছে। বিভিন্ন সময় র্যাব, পুলিশ, ভ্যাট গোয়েন্দারা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। করোনার প্রভাব আর এসব অভিযানের কারণে তাদের ব্যবসা বন্ধের পথে।
ডিএনসির কর্মকর্তারা বলছেন, সব ধরনের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। পুলিশও যেমন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান।
দুটি প্রতিষ্ঠান পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণ করবে এটাই হওয়া উচিত। তা না করে দুটি সংস্থার মধ্যে ঝগড়া বা দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা চলছে। একটি সরকারি সংস্থার লোকজন আরেকটি সরকারি সংস্থার সদস্যের সঙ্গে যে আচরণ করেছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ডিএনসি বলছে, এই অভিযানের সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উত্তরা এলাকার পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। লেকভিউ বারের লাইসেন্স সঠিক আছে। গত মাসেই সে আমাদের অফিসের হয়ে বারটি পরিদর্শন করেন। তাদের কাগজপত্র ঠিক আছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। অভিযানের সময় আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সে ঘটনাস্থলে গেলে ডিবির সদস্যরা তার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছে। এবং তাকে একটি কক্ষে আটকে রেখেছিল। সে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি কারণ তার মোবাইল সিজ করে রাখে পুলিশ।
পুলিশের এসব অভিযোগের বিষয় নিয়ে বারের মালিকরা বলছেন, পুলিশ বা র্যাব অভিযানের নামে যেসব মদের বোতল জব্দ করে নিয়ে যায় পরে সেগুলোর বিপরীতে বৈধ কাজপত্র দেখিয়েই আদালত থেকে ছাড়িয়ে আনতে হয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের।
বারের মালিকদের অভিযোগ, তারা তো বৈধভাবে ব্যবসা করেন। যে থানা বা র্যাবের ব্যাটালিয়নের এলাকায় ব্যবসা করি, তারা ছাড়াও অন্য ইউনিটের সদস্যরা এসেও অভিযান চালান কেন? আমরা তো সব কিছু মেনেই ব্যবসা বাণিজ্য করছি। তাহলে এসব বারের অনুমতি দেওয়ার দরকার কী? বন্ধ হলে সব ধরনের বার বন্ধ হোক।
এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ এর ২৩ ধারায় বলা আছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ পুলিশ, কাস্টমস, বিজিবি, কোস্টগার্ড লাইসেন্স করা প্রতিষ্ঠান ছাড়া যেকোনো মাদকের বিষয়ে অভিযান চালাতে পারে। তবে আইনের ২০ ধারা অনুযায়ী লাইসেন্স নেওয়া প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অভিযান চালাতে পারবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘অধিদপ্তরের ধারায় স্পষ্ট করে বলা রয়েছে, বৈধ বারে অভিযান করতে গেলে আমাদের জানাতে হবে।’
জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আরেক সহকারী পরিচালক বলেন, উত্তরায় শুক্রবার যে অভিযানটি পরিচালনা করা হয় সেটার কোনো তথ্য আমাদের জানানো হয়নি। এই ঘটনাটি পুরোপুরি আইন বিরোধী।
এখানে পুলিশকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অভিযান চালাতে বলেনি। পুলিশ অতিরিক্ত করেছে।
জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি প্রধান) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘কোনো জায়গায় অসামাজিক কার্যকলাপ বা অবৈধভাবে মদ বিক্রি করা হলে পুলিশ যেকোনো সময় অভিযান পরিচালনা করতে পারে।’
উত্তরায় কিংফিশার রেস্টুরেন্ট নামে একটি কথিত বারে পুলিশের অভিযান ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তাহলে ডিবি কীভাবে অভিযান পরিচালনা করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করতে পারে কি না বা মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে পারে কিনা তা আপনারা ভালো জানেন।
তিনি বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, কারা তল্লাশি করবেন বা করবেন না। পুলিশ প্রয়োজনে অবৈধ কোনো জায়গায় অসামাজিক কার্যকলাপ, অবৈধভাবে মদ বিক্রি এবং যে কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশ যে কোনো জায়গায় অভিযান বা তল্লাশি চালাতে পারে। আমরা সবসময় এটা করে আসছি, আমরা বড় বড় চালান ধরছি। এ ছাড়া, অবৈধ বারে আমরা অভিযান পরিচালনা করছি।
কেএম/এমএমএ/