শব্দদূষণ আর যানজটে অতিষ্ঠ নগরজীবন
সারা ঢাকাতে একদিকে যেমন তীব্র যানজট, অন্যদিকে পরিবেশ ও শব্দদূষণ। এই ভোগান্তি যেন রাজধানীবাসীর নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে পড়েছে। শব্দ দূষণ আর যানজটের কবলে পড়ে নাকাল ঢাকাবাসী।
সারা বছর রাজধানীজুড়ে চলছে প্রায় বিভিন্ন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। সড়ক খুঁড়ে রেখে দেওয়া হয় মাসের পর মাস। এতে একদিকে যেমন সড়ক বন্ধের কারণে তৈরি হয় তীব্র যানজট, অন্যদিকে বাতাসের ধূলিকণায় বাড়ছে ভারী বায়ু।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর আজিমপুর, পলাশী মোড়, গুলিস্তান, মগবাজার, হাতিরপুল, তেজগাঁও সহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে রাস্তা খুঁড়ে রাখা হয়েছে। প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিন এসব রাস্তা একক লেনে গাড়ি চলছে যার কারণে তীব্র যানজটে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
আজিমপুরে কথা হয় মিরপুরের পথচারী আবিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, সকালে মিরপুর থেকে রওনা হয়েছি মাত্র আজিমপুর ম্যাটার্র্নিটি হাসপাতালে পৌঁছালাম।
কথা হয় উত্তরা থেকে শাহবাগে আসা যাত্রী আব্দুল মালেক মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, আর কত যানজটে পড়তে হবে। এ শহর আর ভালো লাগেনা ঈদের পর পরিবার নিয়ে বাড়িতে চলে যাবে।
যাত্রাবাড়ি থেকে ঢাবিতে আসা শিক্ষার্থী রুহল বলেন, রাস্তায় এত যানজটের মধ্যে এসে ক্লাস করা মোটেও ভালো লাগছে না।
জানতে চাইলে পলাশী মোড়ে ডিউটিরত ট্রফিক সার্জেন্ট রাজু মিয়া বলেন, আমরা তো সব সময় যানজট নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজ করি। রাস্তা বন্ধ থাকলে আমরা কি করব।
শাহবাগ মোড়ে ডিউটিরত ট্রফিক সার্জেন্ট ইমাম বলেন, প্রতিদিন যানজট নিরসনে আমরা দিনরাত কাজ করে চলছি। ডিউটির সময় একটু ও বসে থাকতে পারি না যানজটের জন্য। এরপর ও কেন যানজট মুক্ত হচ্ছে না তা বলতে পারছি না।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, বিভিন্ন নালা ও ডোবার পানি চলাচল বন্ধ থাকা, যত্রতত্র ময়লা ফেলা ও তা পচে দুর্গন্ধ ছড়ানোর কারণে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। পাশাপাশি অপ্রয়োজনে যানবাহনের হর্ন বাজানোর ফলে ঘটছে শব্দদূষণ। ফলে তীব্র যানজট ও দূষণে নাকাল রাজধানীবাসী। বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকা থেকে নিকট ভবিষ্যতে বের হয়ে আসার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যানজট, পরিবেশ ও শব্দদূষণ এই তিন সূচকে সর্বোচ্চ খারাপ অবস্থান থেকে সরে আসতে পারেনি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নামবিও’র তালিকায় যানজটে ২০১৯ সালে এক নম্বরে থাকলেও করোনাকালে রাজধানীতে যানবাহন তুলনামূলক কম চলায় ২০২১ সালে তার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে ২০২২ সালে যানজট, পরিবেশ ও শব্দদূষণের শীর্ষে রয়েছে ঢাকা। এ বিষয়ে দেখার অনেক সংস্থা থাকলেও তেমন কোনো তৎপরতা নেই সেসব সংস্থার।
যানজটে শীর্ষ রাজধানী ঢাকা
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’র প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেস্ক বলছে, ২০২১ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ যানজটের শহরগুলোর তালিকায় ২৫০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯ম । তাদের গবেষণার ট্রাফিক ইনডেস্কে সর্বোচ্চ পয়েন্ট ধরা হয় ৩০০। এর মধ্যে বাংলাদেশের পয়েন্ট ২৭৪.৮৭। এই তালিকায় ৩৪২ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে রয়েছে নাইজেরিয়ার লোগোস। অন্যদিকে সবচেয়ে কম ৬৯.৪০ পয়েন্ট নিয়ে ২৫০ নম্বরে অর্থাৎ সবচেয়ে কম যানজটের শহর সুইজারল্যান্ডের বাসেল সিটি।
এর আগে ২০২০ সালে ২৬০ পয়েন্ট নিয়ে ঢাকার অবস্থান ছিল ১০। করোনার আগে ২০১৯ সালে ২৯৭ পয়েন্ট নিয়ে ঢাকা ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ যানজটের শহর। ২০১৭ সালে ৩১৭ পয়েন্ট নিয়ে ঢাকা ছিল দ্বিতীয়। ২০১৬ সালে ছিল তৃতীয়।
বিশ্বের বিভিন্ন শহরের নানা পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে অনলাইনে তা প্রকাশ করে নামবিও। এর মধ্যে রয়েছে-জীবনযাপনের খরচ, অপরাধের হার, স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান ও যানজটের অবস্থা। প্রতিষ্ঠানটি তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ফোর্বস, বিজনেস ইনসাইডার, টাইম, দ্য ইকোনমিস্ট, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, চায়না ডেইলি, দ্য টেলিগ্রাফসহ বিশ্বের খ্যাতনামা সংবাদপত্রের তথ্য ব্যবহার করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম-সম্পাদক ও নগরবিদ প্রকৌশলী ইকবাল হাবিব বলেন, যানজট কিংবা শব্দদূষণ--সবই অনেকগুলো সমস্যার উপসর্গ মাত্র।
তিনি বলেন, ’আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জরিপে ঢাকার অবস্থান বাড়ে-কমে, কিন্তু এর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। এখন পর্যন্ত ঢাকার যানজটের মূল কারণ হিসেবে আমরা সবাই জানি, গণপরিবহন কম থাকা ও পথচারীবান্ধব সড়ক না থাকা। কিন্তু এই দুইটা বিষয় কার্যকর করতে আমরা কোনো পদক্ষেপ নেইনি। বরং পরিবহণের সংখ্যা আমাদের বাড়ছে।’
তিনি বলেন, যানজট নিরসনে প্রয়োজন গণপরিবহন বাড়ানো আর ব্যক্তিগত গাড়ি বা মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করা কিন্তু আমরা সেটা করিনি।
বায়ুদূষণে শীর্ষে ঢাকা
বিশ্বের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের দূষণের তথ্যভিত্তিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, একটি দেশও ২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রত্যাশিত বায়ুমানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। এ সমীক্ষা প্রতিবেদন বলা হয় বাংলাদেশ আগের বছরের মতো ২০২১ সালেও সবচেয়ে দূষিত দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। এ ছাড়া, ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত রাজধানী হিসেবে তালিকায় উঠে এসেছে। সমীক্ষায় প্রথমবারের মতো আফ্রিকার দেশগুলোর তথ্য নেওয়ায় চাদ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
২০১৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বাতাসের দেশ ও শহরের তালিকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে শীর্ষ পাঁচে রয়েছে বাংলাদেশ ও রাজধানী ঢাকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে, পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিসের তথ্যানুযায়ী-বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশগুলোর মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর তালিকায় তিন নম্বরে ঢাকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে অনেকের অকাল মৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ সালে ঢাকায় বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম কণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম ২.৫) মাত্রা ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে প্রায় ১৫ গুণ বেশি। গ্রিনপিসের বরাত দিয়ে তারা এ তথ্য জানায়।
শব্দ দূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
ঢাকাবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম কারণ শব্দ দূষণ। অতিরিক্ত শব্দ দূষণে রাজধানীবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা স্বীকার করেছে সরকারী অধিদপ্তর। আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস-২০২১ এ বলা হয়, ঢাকা শহর সহনীয় মাত্রার চেয়ে তিনগুণ তীব্র শব্দ দূষণে আক্রান্ত। যার ফলে অর্ধ-কোটি মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। নির্মাণকাজে সৃষ্ট শব্দ, সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে মাইকের ব্যবহারসহ ট্রাফিক আইন না মেনে চালকদের অতিরিক্ত হর্ন বাজানোকে দায়ী করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলী ইকবাল হাবিব বলেন, শব্দ দূষণ থামাতে প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোও আমরা নিতে পারিনি। ভিআইপিরা যে বিশেষ ধরনের হর্ন ব্যবহার করেন, সেটাই বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এটা তো এমন নয় যে, অসুস্থ কিংবা অশিক্ষিত বা যাদের আইডেন্টিফাই করা যায় না এমন দুষ্কৃতকারীরা হর্ন বাজাচ্ছেন। কাজটা করছে ভিআইপি নামধারী মানুষেরা। আমরা সেটাই বন্ধ করতে পারিনি। আমরা হর্ন দেওয়ার জন্য কোনো ধরনের শাস্তি বা বিধিবিধান করি না। আমরা স্কুল কিংবা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এমনকি সচিবালয়েও হর্ন বন্ধে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারিনি। এত কিছুর পর আমাদের আর পরিবর্তন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডাক্তার আব্দুল মালেক বলেন, রাজধানীতে শব্দ দূষণের কারণে অনেক মানুষ কানে কম শুনতে পায়। বর্তমান এসব রোগীর সংখ্যা বেশি।
তিনি বলেন, আর যানজটের কবলে পড়ে গরমের কারণে কেউ বমি বা অন্যভাবে অনেক মানুষ অসুস্থ্ হচ্ছে। প্রতিদিন এমন সাধারণ পথচারী অসংখ্য মানুষকে আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, দিন দিন মানুষ ঢাকা ছেড়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করছে। কারণ রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণ আর যানজটের কবলে পড়ে বাজে অবস্থায় পড়তে হয় মানুষকে। এমনকি কেউ অসুস্থ্ হলে তাকে হাসপাতালে নিতে নিতেই তার জীবন শেষ হচ্ছে। যদি এ শহরকে বসবাসের উপযুক্ত করতে হয় তাহলে নতুন রূপে বিভিন্ন পরিকল্পনা করতে হবে। অন্যথায় এমন একদিন আসবে এ শহরে এক ঘন্টার পথ চলতে সময় লাগবে ৫ ঘন্টা।
তিনি বলেন, ‘তা ছাড়া সড়কে বিভিন্নি নৈরাজ্য রয়েছে। যেমন, পরিবহন সেক্টর, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি থেকে শুরু করে অনেক সংকট রয়েছে। এসব সংকট সমাধান না হলে রাজধানীতে শব্দ দূষণ আর যানজট কোনোদিন শেষ হবে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (মিডিয়া) উপ-পুলিশ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘ঢাকাতে যানজট পুরোপুরি কমানো সম্ভব নয়। রাস্তার কিছু কাজ হচ্ছে এসব ঠিক হলে হয়তো যানজট কমে আসবে।’
কেএম/এমএমএ/