‘সূর্যালোকে বর্ণমালা’
কীভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়? অসাধারণ সুন্দর তাদের শহীদ মিনার ‘সূর্যালোকে বর্ণমালা’র গল্প লিখে ছবি দিয়েছেন ঢাকা প্রকাশের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রাজিবুল ইসলাম
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারটি অনন্য, সারা দেশে এমন আর একটিও আছে কী না সন্দেহ। নামের মতোই সে দারুণ মনোহর। ‘সূর্যালোকে বণমালা’ আছে ২০ ফিট উঁচু টিলার ওপর। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে। টিলার একেবারে নীচ থেকে সূর্যের আলোতে বর্ণমালাগুলোর রূপ, সুধা, ভালোবাসা ও আবেদন আপনাকে টানতে থাকবে। দিনের ধীরে, ধীরে বেড়ে ওঠা আলোতে ফুটে উঠতে থাকে ভালোবাসা নিয়ে। ফলে অনেক মা-বাবা ছেলেমেয়েকে নিয়ে শহীদদের গড়ে দেওয়া বণমালাগুলোকে দেখতে আসেন। সারা বছর তাদের জীবনে গল্প হয়ে থাকে। তারা মাথায় টুপি নিয়ে হলেও বোরকা পরা বউকে নিয়ে আগামী দিনের মানুষ সন্তান ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন সূর্যালোকে বণমালার কাছে। নিজেদের শ্রদ্ধা জানান গভীর অনুরাগে। তবে এখনো মানুষের পায়ে জুতা পড়ে শহীদ মিনারে উঠে পড়ার, তাদের ভাষায় আমরা তো মিনারের কাছে নেই, তবে তারা জানেন না, পুরো চত্বরই পবিত্র; অভ্যাসটি যায়নি। তরুণ কজন এই ছবিতেই আছেন জুতো পরে পায়ের ওপর পা তুলে গল্প করছেন। এ ঠিক নয় কোনোভাবেই।
মোট ১৮টি সাদা পিলারের বেদি আমাদের ভাষা আন্দোলনের জন্য যারা জেনে, শুনে জীবন দিয়েছেন; তাদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। স্থপতির ভালোবাসায় গড়া এই ভুবনের মানে কারো পক্ষে বিবরণে দেওয়া সম্ভব হবে না। যেভাবে ভাষার জন্য জীবন দেওয়া সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরের আতি কোনোদিনও পূর্ণরূপে জানতে পারবে না কোনো বাংলাদেশী। তাদের ঋণ শোধ হবার নয় কোনোভাবে। আমরা শ্রদ্ধা জানাতে, ভালোবাসতে পারি তাদের। এই স্মৃতি ও ভাষার প্রতি ভালোবাসার ভুবনের প্রতিটি বেদি খাড়া ও সরু, নানা উচ্চতার। মিনারগুলোর ফাঁকায় বাংলা বর্ণমালার বর্ণগুলো তাদের আত্মদানের অহংকারে সেজেছে। পুরো শহীদ মিনার এক পলকে বর্ণমালার একতায় একতাবদ্ধ, প্রতিবাদে মুখর, ভাষার দাবীতে। সকালে মিনারটি ছায়াচ্ছন্ন অস্পষ্ট, ঢেকে থাকে পাহাড়ি ঠান্ডা বাতাসের কুয়াশায়; সূর্যের দিন পরিক্রমায় ক্রমশ আলোকিত ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের মহান ভাষা শহীদরা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন, তারা আমাদের সূর্যসন্তান। দিনের প্রদক্ষিণে আলো-আঁধারের খেলায় সূর্যের সঙ্গে তার এই রক্ত ঢেলে দেওয়া সন্তানদের সঙ্গে অনির্বচনীয়, অনালোকিত, অনাবিস্কৃত কথপোকথন চলতে থাকে। আমরা জানি, বাংলা বর্ণমালাগুলো রোদ পোহায় আমাদের সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শহীদ মিনারে। শক্ত ও প্রবল আক্রোশে ভাষা শহীদরা নেমেছিলেন সেদিন ভাষার দাবীতে পাকিস্তানী বাহিনীর বিপক্ষে। সে কথা বারবার বলে চলে বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনার। বর্ণ হাতে তারা যে অপেক্ষা করছেন আমাদের জন্য এখানে। দূর থেকে কিছু বর্ণমালা কোনোভাবে দেখা যায়। কাছে আসতে থাকলে বর্ণ কুঠুরিগুলোতে ছোট, ছোট বর্ণমালার সমাহারগুলো মিনারের জীবনে স্পষ্ট হয়ে ভাসে। আগের প্রতিটি বছরে মহান একুশের দিনটি শুরু হয়েছে প্রভাতফেরি ঘুরে এই শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণে। কোনো বাধাই আমাদের থামাতে পারেনি। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কর্মকর্তা, কমচারী, ছাত্র-ছাত্রী, সবগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠন অংশগ্রহণের জন্য একত্রিত হয়েছে যখন প্রয়োজন হয়েছে। এই হলো বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সঙ্গে সূর্যালোকে বর্ণমালার মিল। প্রতিটি শহীদ মিনার তার সন্তানদের প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে সঙ্গী হয়েছে। ভালোবাসার ভুবন গড়ে দিয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটকের দল ‘লুব্ধক’ থিয়েটার করে ‘কদাকার’। ভাষার আবেদন, সেদিনের কাহিনী, আমাদের সংগ্রাম ও ভাষাবিরোধীদের কুৎসিত জীবন তুলে আনেন তারা। বাঁধন নিয়ম মেনে অন্যদের মতো স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে দিনভর বিনা পয়সায় রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে। আমাদের সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ সিনেমা দেখায় রাজ্জাক, কবরী, আনোয়ার হোসেন ও রওশন জামিলের ‘জীবন থেকে নেয়া’। অন্য সিনেমাও তারা দেখান দিনভর। সারা দেশের অনলাইন ও পত্রপত্রিকাগুলোতে তাদের সবার, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার খবরগুলো জানাতে ছুটতে থাকি আমরা সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির তরুণ সাংবাদিকের দল। করোনাভাইরাসের আক্রমণে মহামারি রোগ কভিড ১৯’র বিস্তারে গেল বছরই একমাত্র স্বল্প পরিসরে আয়োজিত হয়েছে শহীদ মিনারে একুশের আয়োজন। তবে শিক্ষক সমিতি, উপাচার্য স্যার নিয়ম মেনে এসেছেন। এবারও তারা কম করেই আয়োজনে যাবেন। তারপরও কে বলতে পারে-পরশু থেকে ক্যাম্পাস খোলা, ছাত্র, ছাত্রীদের এখানে ভালোবাসা জানানো ঠেকানো যাবে কী না। হিসেব বলে সম্ভব নয়। কীভাবে সেদিন থাকে সূর্যালোকে বর্ণমালা? যারা আসতে পারেননি, জানতে খুব মন চায় যাদের, প্রবল ভালোবাসেন যারা রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, শফিউরদের জীবন; তাদের জন্য বলা-ভোরে সূর্যের আলো ফুটলেই সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মতিয়ার রহমান হাওলাদার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, রেজিষ্টার ও প্রক্টর স্যারকে নিয়ে আসবেন। তাদের সঙ্গে থাকবে আমাদের দেশের পতাকা; কালো শোকের পতাকা; অর্ধেক নামিয়ে রাখবেন তারা মিনারের ভেতরে। সারাদিন সে সেভাবে শোকের সাগরে ভেসে যাবে। তাদের বুকে কালো ব্যাজ শোকের জন্য থাকবে। যে প্রভাতফেরিতে এসেছেন প্রশাসনের প্রধানরা, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ফুলের মালা দেবেন মিনারের বেদিতে। এরপর সারাদিন ধরে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজে, ছেলেমেয়েকে নিয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে আসবেন শ্রদ্ধা জানাতে। সবার হাতে থাকবে সবসময়ের মতো ফুল। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি ছাত্র ছাত্রী, কর্মকর্তা ও কমচারী সূর্যালোকে বর্ণমালাকে শ্রদ্ধা জানাবেন ফুল দিয়ে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে শহীদ দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানের খবর তো আপনাদের জানা। মিলাদ ও মোনাজাত এবং মন্দিরে, গির্জাতে তাদের আত্মার শান্তি এবং বাংলাদেশের উন্নতি কামনা করে বিশেষ প্রাথনা হবে। বাংলা ভাষার সার্বজননীনতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অধ্যাপকদের মধ্যে আলোচনা হবে। সূর্যাস্তের পর সবার শ্রদ্ধা জানানো শেষে কোনো এক ফাঁকে কালো পতাকা শহীদদের একলা ফেলে রেখে চলে যাবে। তারপরও তারা রয়ে যাবেন সবার মনে। কৃষি অনুষদের ছাত্র সৈয়দ জাহিদকে ২০২২ সালের একুশের আয়োজন নিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেছেন, ‘এবারও আমরা সবসময়ের মতো সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা শহীদ দিবস-একুশে ফেব্রুয়ারিকে পালন করবো, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হবে। সেই প্রস্তুতি আমরা সবাই নিচ্ছি। আমরা মিনারের আশপাশে আলপনা আঁকছি। শহীদ মিনারকে পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন করছি। আশপাশও। মনের ভালোবাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্যে এই কাজে আমাদের কারো কখনো কোনো ক্লান্তি নেই। কেননা এই উচ্চতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ছাত্র, ছাত্রী জানেন, মাতৃভাষা জাতি, ধর্ম, বণ বাদে সব মানুষের মৌলিক সম্পদ; সারা দুনিয়াতেই। মায়ের মুখের ভাষাকে কেন্দ্র করেই প্রতিটি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের একুশের চেতনা আমাদের দেশের প্রতিটি অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাতিঘর। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামের পূণ্যভূমি। আমাদের দেশের মাতৃভাষার দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়েছে বলে গৌরবের শেষ নেই। ফলে সব ভাষাকে সম্মান ও বাংলার গৌবর আমাদের জানাতে হবে।’ এই লেখাটি লিখতে, লিখতে তার সহপাঠী হিসেবে আমারও মনে হলো-পৃথিবীর সব জাতির যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ভাষা। এ শুধু মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমটিই নয়, তার জড়িয়ে থাকে জাতীয় আত্মপরিচয়। সময়ের সাথে নদীর মতো বয়ে চলে ভাষা। সেভাবেই হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষায় বয়ে চলছে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব ও স্বকীয়তা। তবে বাংলা পৃথিবীর একমাত্র ভাষা, যাকে রক্ষা করতে হয়েছে জীবনদানের বিনিময়ে। তাই ২১ শে ফেব্রুয়ারি ‘ভাষা শহীদ’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়। ১৯৫২ সালের একুশের পথ ধরেই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। একুশের চেতনায় আমরা এই দেশের মানুষরা এগিয়ে চলেছি।
ওএস।