তারারাও মেঘেদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে
তাল সামলাতে না পেরে তাল ঠুকতে, ঠুকতে মিকসেতু মিঠু ও তার চার বন্ধু চললেন সেন্ট মার্টিনে। বেড়ালেন, আমাদেরও ঘোরালেন। ছবিও দিলেন ভালো
সাঁঝের আলোয়
‘চোখটা এত পোড়ায় কেন?/ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও/সমুদ্র কি তোমার ছেলে?/ আদর দিয়ে চোখে মাখাও’-বঙ্গোপসাগর দেখার অপেক্ষায় গায়ক, সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরীর মতো আমার দুটি চোখও পুড়েছে দীর্ঘদিন। অবশেষে সুযোগ মিলল। ব্যাগ, বোচকা গুছিয়ে নিলাম। রাত নয়টায় যখন বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হব, জানা গেল-টেকনাফের শেষ বাসটিও ঢাকা ছেড়ে গিয়েছে; তাও রাত মোটে সাড়ে আটটায়! বাসের সাথে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার জাহাজগুলোর টাইমিং মেলাতে হয়-সে তো আমার জানা নেই। এবার জানা হলো। আরো জানলাম, এই কারণেই বাসের চলে যাবার এতো তাড়া থাকে। তবে আমি তাই বলে থেমে থাকলাম না। ফিরে এসে পরদিন বাংলাদেশের প্রবাল দ্বীপটির উদ্দেশ্যে সাঁঝের আলোয় বিদায় ঢাকা জানালাম আমরা পাঁচজন।
যেখানে আকাশ নীল, পানিও নীল
বাসে ঢাকা থেকে টেকনাফ ঘাটে বাস পৌঁছলো পরদিন সকাল ছয়টায়। সেন্ট মার্টিনের জাহাজ ছাড়বে নয়টায়। জাহাজের ক্যাপ্টেন থেকে ঘাটের পানের দোকানদার-সবাই টিকিট গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় ট্যুরিস্টদের সঙ্গে কথা চালাচ্ছে। দুই-একজন রোহিঙ্গা শিশুকেও দেখলাম-এর, ওর ফুট ফরমায়েশ খাটছে। সুর্য তখন নীলচে নাফ নদীর ওপর থেকে উঁকি দিচ্ছে।
স্নিগ্ধ অথবা চিপস প্রিয় গাঙচিল
‘ইচ্ছে হলে ভালোবাসিস/না হয় থাকিস/যেমন থাকে স্নিগ্ধ গাঙচিল’ শিরোনামহীন ব্যান্ডের গানটি শুনে, শুনে গাঙচিলের স্নিগ্ধতার স্বরূপ আঁকা ছিল মনে কিন্তু জাহাজ ছাড়তেই যে হাজারখানেক ওরা রওয়ানা দিল আমাদের সঙ্গে! তারা যতোটা স্নিগ্ধ, ততটাই ভালোবাসা নিয়ে উড়ছে। তবে উড়ে, উড়ে চিপস খেতেই ব্যস্ত। জাহাজ থেকে ভ্রমণবিলাসীরা চিপস ছুঁড়ে দিচ্ছেন, আকাশে সাদা শুভ্রতা গাঙচিলগুলো উড়ে চলেই খাচ্ছে। একজন বলেই বসলেন, আমাদের সাকিব আল হাসানরাও তো এত নিখুঁত ক্যাচ ধরতে পারে না! তাতে সবাই হেসে ফেললেন। অনেকে চিপসের প্যাকেট খালি করে ফেললেন সাগরপাখিদের খাইয়ে। একপাশে শাহ পরীর দ্বীপ, অন্যপাশে মিয়ানমারের নাফ নদী, মাঝে জাহাজ চলছে নীল থেকে নীলাভ জলের পানে।
দরজা বন্ধ করলে ঘর, খুললে সাগর
প্রবাল দ্বীপটিতে পৌঁছে আমরা নামকাওয়াস্তের যে হোটেলে উঠলাম, সেটির সঙ্গে ঘর ও সমুদ্রের মাঝে একটি মোটে দরজার তফাৎ। ফলে আমি দরজা খুলে রেখেই সাগর দেখতে লাগলাম বন্ধুদের মতো। জীবনের প্রথম সাগর জলের স্পর্শ নেওয়ার তর সই ছিল না বলে ব্যাগ কোনোরকমে ফেলেই দে দৌড়। নীল জলরাশির আছড়ে পড়া সাদা ফেনাময় জল বুকে জড়িয়ে ধরলো আমাকেও। তখন মধ্য দুপুর। জোয়ার কম বলে আশপাশে অনেকে গোসলে নেমেছেন। সাগরের ভাসমান ফটোগ্রাফারদের সঙ্গে দামাদামি করে ছবি তুলতে লেগে গেলেন। কেউ আবার ফুটবল পায়ে মডেল হলেন রোনালদো কী মেসি। কেউবা তীরে কাঠের চেয়ার ভাড়া করে আধাশোয়া হয়ে গেলেন হুমায়ূন আহমেদের মতো, সাগর বিলাসে ব্যস্ত। এই অন্যরকম, আজব দর্শকদের উৎসাহ দেখে বোধকরি তার জলের ঢেউগুলো উঁচু থেকে আরো উঁচু হতে লাগল। দূর থেকে দেখছি, ঢেউয়ের দোলায় দুলছেন গোসলে মত্তরা।
মাছে ভাতে বাঙালি
দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাঙালির যে ঐতিহ্যগুলো বিলুপ্তির পথে তার একটি-‘মাছে ভাতে বাঙালি’। সেন্ট মার্টিনের হিসাব কিন্তু আলাদা। মোটে ৮ বর্গ কিলোমিটারের দ্বীপটির যেদিকে তাকাবেন-সমুদ্র। সেভাবে এখানে ছোট, ছোট স্থানীয়দের যে হোটেলেই খান না কেন, সাগরের মাছগুলো প্লেটে পড়বে। নাম চেনেন সবাই পত্রিকার সূত্রে কিন্তু চেখে দেখার সুযোগ সেন্ট মার্টিনে অবারিত। কোরাল, রূপচাঁদা, ইলিশ, লইট্টা, রিটা, চিংড়ি ইত্যাদি। আরো আছে নাম না জানা কত, শত মাছ। এক বা দুই পিস; আস্ত ভাজিও খেতে পারেন। পকেট ও পেটের অবস্থা বুঝেই তো ব্যবস্থা।
চকচক করলেই রেডিয়েন্ট হয় না
গোসল, খাওয়া ও বিছানায় হালকা বিশ্রামেই দিন যে ফুরিয়ে গেল! তাই সাহসে ভর দিয়ে রাতেই নামলাম দ্বিতীয় দফার সাগর দর্শনে। ভীষণ সাগরে আলো নেই। আকাশে যে চাঁদটিও নেই। পূর্ণিমা সে পেরিয়ে গিয়েছে, সপ্তাহটি খানেক আগে। অল্প কটি তারা জ্বলছে, তারাও মেঘেদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। ভরা পূর্ণিমায় সাগরের সৌন্দর্য তো আমাদের দেখা হলো না। আঁধারের সমুদ্রেরও সৌন্দর্য আছে। কালো অন্ধকারের ভেতর দূর সাগরে উঁকি দিলো এক টুকরো সাদা ফেনা। দুপাশে থেকে বড় হতে, হতে তীরে এসে আছড়ে পড়লো। বারবার দেখছি মোরা। এমনই এক ঢেউয়ের বিদায়ে তীরে কী যেন চিক চিক করে জ্বলছে। কাছে গিয়ে দেখি, একটি, দুইটি, তিনটি করে শত, সহস্র রেডিয়েন্ট! এক ধরনের বালুকণা ওরা, অন্ধকারেও জ্বলে। মোবাইলের আলো ধরলে হারিয়ে যায়। চাঁদের আলোতেও তাই। তবে অন্ধকারে তারা সহায় হয় দারুণ জ্বলে। সেন্ট মার্টিনের পাড় জুড়ে রেডিয়েন্টের ঝিকিমিকি দেখতে, দেখতে পূর্ণিমায় সাগর না দেখার আফসোসটি রইল না।
বাংলাদেশের শেষ স্থলভূমি
গোটা সেন্ট মার্টিনই স্বর্গীয় ভূমি। যেদিকেই তাকাই, সুন্দর-সে খুব সুন্দর। সৈকতে বসে থাকতে ভালো লাগে, হাঁটলেও খুব ভালো লাগে। এক পাড়ে তার নারিকেলের সারি, আন্য পাড়ে প্রবাল প্রাচীরে সাদা ফেনাগুলো আছড়ে পড়ছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সমুদ্রের শোঁ, শোঁ-উত্তাল গর্জন। জিপিএ ফাইভ পেলেও মুরুব্বিরা যেমন বলেন, ভালোর কোনো শেষ নেই, গোল্ডেন-এ প্লাস পেতেই হবে তাই। ফলে গোল্ডেন-এ প্লাস দেখার আশায় সাইকেল ভাড়া নিয়ে রওয়ানা দিলাম ছেঁড়া দ্বীপে। দ্বীপটির সঙ্গে সাগরের জোয়ার-ভাটার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব আছে। হিসাব কষেই বেড়িয়েছি। সেন্ট মার্টিন ও ছেঁড়া দ্বীপের মাঝে ১শ মিটার প্রবালপথ, জোয়ারের সময় প্রবাল প্রাচীরে গড়া পথটি ডুবে যায়। ভাটার সময়ে যাওয়ার নিয়ম। ২৫ কী ৩০ মিনিট সাইকেল চালিয়ে আমরা যেখানে এলাম সত্যিই তা সৌন্দর্যের স্বর্গের পূণ্যভূমি। ৫শ বর্গমিটারের প্রবালে ঘেরা এক টুকরো সবুজ বন, এটিই ছেঁড়াদ্বীপ বা ছেঁড়াদিয়া দ্বীপ। থোকা, থোকা সবুজগুলো কেয়া বৃক্ষ। কেয়া বনটি পেরুলেই ফের প্রবাল রাজত্ব, দক্ষিণটিই বাংলাদেশের শেষ স্থলভূমি। সেন্ট মার্টিনকে পেছনে ফেলে শেষ প্রবালটিরও ওপর দাঁড়িয়ে আছি। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি। তাকিয়ে থাকতে, থাকতে এই পোড়া চোখে কখন যে ঘোর লেগে গেলো, টের তো পেলাম না।
যাবেন? করবেন ও করবেন না
ঢাকা ছাড়াও কক্সবাজার, চট্টগ্রামে থেকে জাহাজে সেন্টমার্টিন পৌঁছানো যায়। তুলনায় লম্বা সময় জলের বুকে ভাসতে হয়-এই আর কী। জাহাজে বা সাগর পাড়ে চিপস, বিস্কুটের প্যাকেটসহ কোনো ধরণের ময়লা, আবর্জনাই সাগর বা অন্য কোথাও নয়; ময়লার নির্দিষ্ট ঝুড়িগুলোতে ফেলতে হবে কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিনকে বাঁচিয়ে রাখতে। কেননা, প্রবালদের প্রাণ আছে। এমন পরিবেশ আর কোথাও নেই; বিশ্বেই বিরল।