গভীর রাতে ‘হিমেল’ মারা গেছে
লেখা ও ছবি সংগ্রহ: তানভীর তুষার
কাঁদছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। শহীদ শামসুজ্জোহার রক্তে আবার লাল হলো উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় ও বাংলাদেশের প্রাচীনতম ক্যাম্পাসগুলোর একটি। এ বড় দু:খের ঘটনা। মঙ্গলবার রাত নয়টায়; ক্যাম্পাসে তখন অনেক রাত; গান, আড্ডা শেষে, খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে কোথাও কেউ নেই-এর বিশ্ববিদ্যালয় তখন ঘুমুতে গিয়েছে।
কটি ছাত্র, ছাত্রী বাড়িতে না থেকে ভালোবাসার ক্যাম্পাসে আছেন। কজনের পকেট প্রায় সময়ই খালি থাকে। তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তারাও মোবাইল হাতে গল্প বলার সময়ে অধীর। ঠিক তখনই এলো দু:সংবাদ।
মাহবুব হিমেলকে অনেকে চেনেন। থমকে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এক জাগ্রত প্রাণ। অনেক গুণের মানুষ। রাজশাহী ইউনির্ভাসিটি ড্রামা অ্যাসোসিয়েশন (রুডা)’র বহু দিনের কর্মী। অনেক অবদান তার এখানে। আছেন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। তাছাড়াও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দফতর সম্পাদক হিসেবেও তার নানা ভূমিকা আছে। কোনোদিনও সেসব আলোচনায় আসেনি, এলেন হঠাৎ মারা যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রটি।
তিনি অত্যন্ত সৃজনশীল। মেধাবীও বটে। পড়ালেখা করেন চারুকলা অনুষদে। চতুর্থ বষের ছাত্র। চিত্রকর্ম, শিল্পকর্ম, পোস্টার, ব্যানার, লিফলেট ইত্যাদি কাজগুলোতে তার মেধা ছড়িয়ে আছে।
রাতের ক্যাম্পাসে কাজ সেরে ফিরছিলেন তিনি। শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি ও রাইহান প্রামাণিক। তারা মোটরসাইকেলে আসছিলেন। চালক তিনি-হিমেলই। এখানেই বানানো হচ্ছে ২০ তলা অ্যাকাডেমিক ভবন। একটি বহুতল আবাসিক হলের কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে।
রাত-দিন কাজ হয় সবসময়। ইট, বালু, সিমেন্ট, রড ট্রাকে আনা-নেওয়া করতে হয় যখন, তখন। তবে বেখেয়ালে হিমেল ও রাইহানের মোটর সাইকেলটিকে চাপা দিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে ছুটে আসা দানবীয় ট্রাক। ওতে হল ও অ্যাকাডেমিক ভবনের নানা নিমাণ উপকরণ ছিল। মোটর সাইকেল বাঁচাতে, রাইহানকে আরো সাবধান করতে ব্রেক ফেল করলেন হিমেল।
ট্রাকের ড্রাইভার ও তার হেলপার এবং অন্যদের কোনো খবর জানা যায়নি তখন। তারা মোটরসাইকেল চাপা দিলেন।
মারা গেলেন হিমেল, রাইহানকে আশংকাজনক অবস্থায় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে (রামেক) ভর্তি করা হয়েছে এরপর। তবে তিনি এখন আশংকামুক্ত। তার একটি পা ভেঙেছিল।
রাইহান প্রামাণিক পড়েন সিরাকিকসে। বয়স একই-২৪; অনুষদও একটিই। এখনো তিনি রামেকে ভর্তি আছেন।
মাহবুব হিমেলের মৃত্যু সংবাদ সঙ্গে, সঙ্গে ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে গেল ছাত্র, ছাত্রী এবং শিক্ষকদের মাধ্যমে। তারা একে, একে হল ও শহর থেকে আসতে লাগলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রধান ফটক দিয়ে, নানাভাবে তারা চলে এলেন শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনে। তারপর থেকে লাল উত্তাপ ছড়িয়ে গেল একটু একটু করে।
তারা ওই ট্রাকটি আটক করেছেন। এরপর পাঁচটি ট্রাকে আগুন ধরিয়ে সেগুলোকে পুড়িয়ে দিয়েছেন রাজশাহীর ছাত্র, ছাত্রীরা।
তবে আগুন থামেনি। রাত ১০টার মধ্যেই রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কটি পুরোপুরি অচল করে দিয়েছেন তারা।
অবরোধে কোনো গাড়ি, ঘোড়া; গরুর বাহন যেতে পারেনি ওই একমাত্র মহাসড়কটি ধরে। কয়েকশজন মিলে শিক্ষকদের সঙ্গে বন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করেছেন প্রাণপণে। তারা সবাই মিলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন সেখানে গাছ, টায়ার ফেলে।
এর আগে গিয়েছেন তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তারের কাছে। সেখানে তারা তার বাসা ঘেরাও করেছেন। ক্যাম্পাসে বাড়ি অথচ তিনি বের হবার সাহস করতে পারেননি। কী বলবেন প্রিয় ছেলেমেয়েদের?
বন্ধুর লাশকে পাশে রেখে এই আন্দোলনের কমীরা একটুকু ছাড় দেননি কাউকে। রাত ১১টায় কারো কাছ থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে মাহবুব হিমেলের লাশ নিয়ে একদল শোকার্ত মানুষ তুষার ভেজা সড়ক ধরে চলে গেলেন শোকের সাগরে ভাসতে ভাসতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে।
তাকে চিকিৎসকদের কাছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য জমা দিয়ে তারা আবার প্রতিবাদের স্রোতে গেলেন। প্রচণ্ড শীতে, সামান্য পোশাকে; গায়ে তাদের উলের সুয়েটার কী চাদর কী জিন্সের জ্যাকেট; রাত ১২টার প্রবল ঠান্ডাকে ফাঁকি দিয়ে তারা সারা ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে মিছিল ও প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। তখন আমাদের কাছে এই খবর এলো-‘হিমেল মারা গিয়েছেন।’
তাদের সঙ্গে এরপর ভিসি স্যারের আলাপ হলো। তিনি বেরিয়ে এসে ছাত্র, ছাত্রীদের শান্ত করতে নামলেন। তখনো ভয়ে ফোন ধরেননি প্রথমবারের মতোই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর লিয়াকত আলী।
ভিসি স্যার তাদের সঙ্গে আছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচায অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেছেন, ‘আমি এই ঘটনাকে অ্যাকসিডেন্ট বলব না, আমার মতে, হিমেলকে খুন করা হয়েছে। আমার আজ বড় দু:খের দিন। আমার একটি সন্তান, একজন ছাত্র এই ক্যাম্পাসে মারা গিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি আমি চাই। উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মেয়র, সরকারী প্রশাসন ও অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে আমি আলাপ করেছি।’
তিনি আরো বলেছেন, ‘মাহবুব হিমেলের পরিবারের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। তাদের জন্য আমার বেদনা জানানো ভাষা নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করবে।’
ওএস।