‘সাড়া দাও, সাড়া দাও, উদাসীন থেকো না’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা আন্দোলনে নেমেছেন ছাত্র, ছাত্রীরা। তাদের এই আন্দোলনের ছবি প্রদর্শনী হচ্ছে, ক্যাম্পাসের সড়ক ও দালানগুলোতে তারা ছবি এঁকেছেন, শ্লোগান লিখেছেন; প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। সেগুলো নিয়ে লিখেছেন নুরুল ইসলাম রুদ্র, ছবি তুলেছেন জুবায়েদুল হক রবিন
আন্দোলনের উত্তাপ থেমেছে জাফর স্যারের ডাকে
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (সাস্ট)’র উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে ১৭ দিন ধরে টানা আন্দোলন করে যাচ্ছেন ছাত্র, ছাত্রীরা। শুরুর দিন থেকে বিক্ষোভ মিছিল, অনশন, ভিসির বাসভবন ঘেরাওসহ নানা কমসূচিতে প্রতিদিনই উত্তাল ছিল পুরো ক্যাম্পাস। বিভিন্ন শ্লোগানে মুখর ছিল সাস্ট। তবে এখন আর আগের মতো উত্তাল নেই ক্যাম্পাস। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমিন হক তাদের অনশন ভাঙিয়েছেন। ফলে ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছে নিরবতা।
প্রতিবাদে মুখর দেওয়াল ও সড়কগুলো
তারপরও তারা আন্দোলনে আছেন। তাতে পাল্টে গেছে প্রতিবাদের ভাষা। তাদের প্রতিবাদী শ্লোগানগুলো এখন ছুঁয়ে আছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি দেয়াল ও রাস্তা। রং-তুলির ছোঁয়ায় অন্যরকম প্রতিবাদে মেতেছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ভবনগুলো, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি ভবন, গোলচত্বরসহ পুরো ক্যাম্পাসেই উপাচার্যবিরোধী নানা শ্লোগান লিখে তার পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছেন ছাত্র, ছাত্রীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ‘সেভ সাস্ট’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন চৌধুরীর পদত্যাগের দাবিতে শ্লোগানগুলো দেয়ালে ও সড়কে ফুটিয়ে তুলেছেন। ক্যাম্পাসের গোলচত্বরের অর্ধেক জুড়ে ‘পতন, পতন, পতন চাই, স্বৈরাচারের পতন চাই’, ‘যেই ভিসি মিথ্যা বলে, সেই ভিসি চাই না’, ‘যেই ভিসি বোমা মারে, সেই ভিসি চাই না’, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, শাবিপ্রবি মুক্তি পাক’ শ্লোগানগুলো লেখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দেওয়ালে ‘হীরক ভিসির শেষে’, ‘মৃত্যুর মুখে দাঁড়ালে আয়ু বেড়ে যায়’, ভিসি-সমিতি একজোট’, ‘বোমাচার্য’, ‘সব জুলুমশাহীর পতন হোক’, ‘সাড়া দাও, সাড়া দাও, উদাসীন থেকো না’, ‘কিছু মাতাল হাওয়ার দল, শোনে ঝোড়ো সময়ের গান’, ‘ফুলের বিরুদ্ধে বুলেট হলে বুলেটের বিরুদ্ধে কী?’, ‘আমার ঘর, আমার দোর, তুই কোথাকার ভুঁইফোঁড়?’ ইত্যাদি শ্লোগান লেখার মাধ্যমে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষকের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ
১৯ জানুয়ারি ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষকদের নিয়ে ‘কুরুচিপূর্ণ ও অসদাচরণ’ আচরণের অভিযোগ’ এনে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মানববন্ধনের সময় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক লায়লা আশরাফুনের দেয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে ‘চাষাভূষার সন্তান, আমরা সবাই সাস্টিয়ান’, ‘চাষাভূষার ক্যাম্পাস’ ইত্যাদি শ্লোগান লিখে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তারা।
আছে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলোসহ উপাচার্যের ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’তে ছেয়ে গিয়েছে পুরো ক্যাম্পাস। ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি-ভিসি পদ ফাঁকা আছে’ গ্রাফিতির মাধ্যমে নতুন উপাচার্যের দাবি জানাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে ছাত্র, ছাত্রীরা জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের অনেক রকমের ক্ষোভ রয়েছে। নাম না বলে একজন বলেছেন, ‘এর আগে ক্যাম্পাসে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া আমাদের কখনো বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, রোড পেইংটিং, গ্রাফিতি, দেয়াললিখন ইত্যাদি কাজগুলো করতে দেওয়া হতো না। অথচ এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিভিন্ন দিবসে শিক্ষার্থীরা এসবের মাধ্যমে তাদের প্রতিভাকে তুলে ধরতে পারে। আমাদের সেসব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে উপাচার্য আমাদের এই অধিকারগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন, আমরা তাকে আর চাই না, আমরা তার পদত্যাগ চাই।’
আলপনার গল্প
এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে উপাচার্যের বাসভবনের সামনের অনশনস্থলে আলপনা এঁকেছেন তারা। উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে অনশনকারীদের প্রতি সম্মান জানাতে ও তাদের অনশনের দিনগুলোর স্মৃতি ধরে রাখতেই এমন কাজ করা হয়েছে। গিয়ে দেখা গিয়েছে, অনশনস্থলে তারা রং, তুলির সাহায্যে লিখে রেখেছেন আন্দোলনটির মূলমন্ত্র ‘মৃত্যু অথবা মুক্তি’। চিত্রটির ওপরে একটি স্যালাইনের স্ট্যান্ড আঁকা আছে, তাতে ঝুলন্ত একটি স্যালাইন আছে। অনশনে অংশ নেওয়া পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র শাহরিয়ার আবেদীন বলেছেন, ‘এ চিত্রে আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা যখন অহিংস পথে ছিলাম আমাদের তখনকার অবস্থা, আমাদের মনোবল ও দৃঢ় প্রত্যয় আছে।’
আলোকচিত্রে একদফা
গতকাল সোমবার বিকেল পাঁচটা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চত্বরের পাশে ‘আলোকচিত্রে এক দফা’ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। তাতে ছাত্র, ছাত্রীদের ওপর পুলিশের হামলা ও উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনের বিভিন্ন মুহূর্তের চিত্র অন্যদের দেখার ও ক্যাম্পাসে প্রদর্শনী করতে রেখেছেন তারা। এটি আছে সাস্টের কিলো রোডের পাশে। সবুজ সামিয়ানায় ভেতরে ছবিগুলো টাঙানো। সামিয়ানায় পিন দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছেন ১শ ৫০টির বেশি ছবি। সবগুলোই ছাত্র, ছাত্রীদের তোলা। প্রতিটি ছবিতে ফুটে উঠেছে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুহূতগুলো। আরো ফুটেছে শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশের হামলার চিত্র। কটি ছবিতে শ্লোগান মুখর সাস্টের ছাত্র, ছাত্রীরা। শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার ছবি আছে। কিছু ছবিতে ক্যাম্পাসের ভেতরে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেওয়া পুলিশ বাহিনীর সামনে ছাত্র, ছাত্রীরা হাঁটু মুড়ে ফুল হাতে তাকিয়ে আছে। এই প্রদর্শনী দেখতে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজীব বাবু ও শাদমান শাবাব। তারা বলেছেন, প্রতিটি ছবিই প্রতিটি মুহূর্তের কথা বলছে। একদিকে পুলিশের নির্মম নির্যাতন অন্যদিকে ছাত্রদের প্রতিবাদী আন্দোলন। সবই ফুটে উঠেছে আলোকচিত্রমালায়। বিভিন্ন মুহূর্তের খন্ড, খন্ড ছবিগুলোতে ফুটে উঠেছে সমগ্র আন্দোলনের চিত্র। আন্দোলনরত ছাত্র জাহিদুল ইসলাম অপূর্ব বলেন, ‘এতে আমরা আন্দোলনের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি প্রমাণ্য দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেছি।’
ওএস।