সাস্টে মার খেয়েছেন ছাত্র, ছাত্রীরা
১৬ জানুয়ারি শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাস্ট) বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হল প্রভোস্টের ‘পদত্যাগ’ দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালিয়েছে পুলিশ। ছাত্র, ছাত্রীদের লক্ষ্য করে ২৭ রাউন্ড রাবার বুলেট, ২১টি সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়েছেন তারা। ঠিক কী কারণে তাদের হামলা করেছে? কী ঘটেছিল সেদিন? লিখেছেন নুরুল ইসলাম রুদ্র। ছবি : সংগ্রহ
“১৬ জানুয়ারি, বিকাল ৫টা। সাধারণ ছুটির সময় থাকে তখন। তবে সেদিন ছাত্র, ছাত্রীরা ক্ষোভে উত্তাল। তাদের দাবি মেনে নিতে অবরুদ্ধ উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে আইআইসিটি (ইন্সটিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি) ভবনের গেটের সামনে গেলেন সাস্টের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম। ছাত্রীরা তাকে তালা খুলে দিতে চাবি খুঁজতে লাগলেন। তখনই ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে আসা পুলিশ সদস্যরা বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে মারমুখি অবস্থান নিয়ে নিলেন। তারপর তারা সবাই মিলে আমাদের ওপর লাঠিচার্জ মানে লাঠি দিয়ে বেড়ধক মারা শুরু করলেন। আমরা দুটি স্তরে আন্দোলন করছিলাম। ভেতরে মেয়েরা, বাইরে ছেলেদের-মানব শিকল। পুলিশ প্রথমে লাঠি দিয়ে প্রবলভাবে পেটাতে, পেটাতে আমাদের সামনের মানব শিকল ভাঙল। এ সময় ধরে, ধরে আমাদের হাতে, পেটে ও পিঠে অতর্কিতে হামলা চালিয়েছে তারা। মার খেয়ে সরে যাবার পর সাস্টের ছাত্রীদের মানব শিকলের ওপর হামলা চালিয়েছে। মারতে, মারতে আমাদের অনেককে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। সেই মুহূর্তেও লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে”-নিরস্ত্র ছাত্র,ছাত্রীদের উপর পুলিশের হামলার বর্ণনা দিলেন সজল কুণ্ডু। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা হলের প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র, ছাত্রীদের অন্যতম। নৃবিজ্ঞান পড়েন। তাকেও প্রচণ্ড মেরেছে পুলিশ ক্যাম্পাসের ভেতরে। সজলকে পুলিশ বাহিনী ছিটা গুলি ছুঁড়েছে ও সাউন্ড গ্রেনেড মেরেছে। গ্রেনেড হামলায় সজলের শরীরের অন্তত ৮৩টি জায়গা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। বন্ধুরা তাকে দ্রুত তুলে নিয়ে হাসপাতালে ভতি করে তার জীবন বাঁচিয়েছেন। এক্স-রেতে জানা গিয়েছে, তার শরীরের মাথা, কান, গলার নিচ, হাত, আঙ্গুল, বুক, পেটসহ পুরো শরীরে আঘাত আছে। কোনো, কোনোটি গুরুতর। কীভাবে পুলিশ তার উপর হামলাটি চালিয়েছে-সেই হৃদয়বিদারক বর্ণনা কাঁদতে, কাঁদতে সজল দিয়েছেন, ‘আমি ছিলাম সাস্ট ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরে। দেখেছি, কয়েকজন পুলিশ ঘিরে, ঘিরে আমাদের কয়েকজন ছাত্রকে নির্দিষ্টভাবে লক্ষ্য করে বেধড়ক মারধর করছে, লাথি মারছে, পেটাচ্ছে। তাদের ভয়াবহ কষ্ট দেখে থাকতে না পরে বেরিয়ে ছুটে গিয়েছি। ওদের আমরা পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে বেষ্টনি থেকে বের করে এনেছি। ঠিক তখনই একজন পুলিশ সদস্য আমাকে লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করল। আমার পায়ের কাছে এসে ফাটল শব্দ করে। মনে হয়েছে, আমি কয়েকশ ভোল্টের একটি বিদ্যুৎ শক অনুভব করছি। কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তদ্ধ ও বধির হয়ে গেলাম। নড়তেও পারছি না। প্রিয় বন্ধু রাকিব আমাকে ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরে নিয়ে গেল। এরপর খেয়াল ফিরে এলো। দেখলাম, ডান হাত দিয়ে জলস্রোতের মতো রক্তস্রোত বেরুচ্ছে। ব্যথায় কাঁদছি। দুই কী তিনটা গামছা দিয়ে হাতটি বেঁধে রক্তপড়া বন্ধ করার চেষ্টা করছে ওরা। ততক্ষণে মাথা থেকেও রক্ত বের হচ্ছে। শরীরের কাপড় ছিদ্র হয়ে গেছে। হাসপাতালে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের কাঁধে উপর ভর দিয়ে যাচ্ছিলাম। সামনে দেখে বন্ধুরা পুলিশকে বলেছিল, ‘ভাই, ও শারিরীভাবে আঘাত পেয়েছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।’ শুনে পুলিশরা কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তবে যখনই আমরা তাদের সীমানার মধ্যে ঢুকলাম, সবাইকে আবার লাঠিপেটা শুরু করলো। আমি আহত শরীরটিকে কোনোমতে টেনে-হিঁচড়ে ক্যাম্পাসের গোলচত্বরের সামনে এসে জীবন বাঁচালাম। অন্যরা তখন মার খাচ্ছে। ওরা আমাকে সরিয়ে দিয়েছিল।”
এই আন্দোলনে পুলিশের গুরুতর হামলায় পিটুনির শিকার হয়েছেন পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ফাতিন আল সাদাফ। বলেছেন, ‘আমরা ওই মানব শিকলটি তৈরি করে বোনদেরকে রক্ষা করতে চেয়েছি। পুলিশ অতর্কিত হামলা করেছে আমাদের ওপর। আমাদের মারতে, মারতে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। আমিসহ আরো কয়েকজনকে বুট দিয়ে লাথি মেরেছে, লাঠি দিয়ে বারবার পিটিয়েছে। আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত হয়েছে, থেঁতলে দেওয়া হয়েছে আমাদের কয়েকজনের শরীর।’
একজন অধ্যাপককে বাঁচাতে গিয়ে নিজের একটি হাত ভেঙেছেন গণিতের ছাত্র নজরুল ইসলাম রাকিব, ‘মানব শিকলে হামলা করে তখন পুলিশ ছাত্র, শিক্ষক সবাইকে বেধড়ক মারধর করেছে। আমার সামনেই একজন প্রিয় অধ্যাপককে লাঠিচার্জ করা শুরু করলো তারা। থাকতে না পেরে, জীবনের পরোয়া না করে আমি বাধা দিতে এগিয়ে গেলাম। মার খেয়ে আমার বাম হাতের একটি আঙ্গুল ভেঙে গেল। শিক্ষকের ওপর আঘাত ঠেকাতে তখন দুই হাতের তালুতেও খুব ব্যথা পেয়েছি মারে।’ এখন তিনি চিকিৎসাধীন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-সাস্টের আরেকটি কালো দিবসে তাদের মতো অন্তত ৫০ জন ছাত্র, ছাত্রী ভয়াবহ পুলিশী হামলার শিকার হয়েছেন। কেবল সাধারণ ছাত্র, ছাত্রীরাই নন, এই হামলা ঠেকাতে ও সবাইকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কমীরা। সাস্ট ছাত্রলীগের একজন কর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তৌহিদকে লাঠি দিয়ে পেটাতে, পেটাতে পুকুরে ফেলে দিয়েছে পুলিশ বাহিনী। তিনি নৃবিজ্ঞানে পড়েন। এরপর পুলিশরা পানিতে নেমে ফের তাকে লাঠি দিয়ে বারবার মেরেছে। অজ্ঞান তৌহিদের জ্ঞান ফিরেছে হাসপাতালের বেডে। জ্ঞান ফেরার পরও তৌহিদ আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলেন বলে স্বাক্ষ্য দিয়েছেন সহপাঠীরা।
লুকিয়ে নয়, জীবন বাঁচাতে বন্ধুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি মানুষ। শিক্ষার্থীদের পুলিশের মারধরের দৃশ্যে নিরবে কেঁদেছেন অনেকে। কেঁদেছেন তাদের সহপাঠী ও বন্ধুরা। তারা কেউ-ই ভালো নেই। হাসপাতালের ডাক্তারেদের চেম্বার ও বেড রুমে কাটছে জীবন । সজলকে চিকিৎসক জানিয়েছেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। তার সব চিকিৎসার খরচ শেখ হাসিনার তহবিল থেকে দেওয়া হবে জানিয়েছে সরকার। সজল বলেছেন, ‘আজ সোমবার আমাকে বিএসএমএমইউতে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল ইউনিবাসিটি) নিয়ে যাওয়া হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বোর্ড বসিয়ে চিকিৎসা শুরু করবেন। সে অনুযায়ী উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হবে।’
এ ঘটনায় শিক্ষকদের প্রতি ছাত্র, ছাত্রীদের কষ্টের জন্ম হয়েছে জানিয়েছেন অনেক ছাত্র, ছাত্রী। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। পদার্থবিজ্ঞানের শাহরিয়ার আবেদীন বলেছেন, ‘ সাস্টের ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক জহীর উদ্দিন আহমদ ও প্রক্টর ড. আলমগীর কবীরের উপস্থিতিতে সাধারণ ছাত্র, ছাত্রীদের ওপর পুলিশ হামলা করেছে। তারা কেউ পুলিশকে বাধা দেননি। আরো অনেক অধ্যাপক এসময় উপস্থিত ছিলেন। আমাদের ওপর পুলিশের হামলায় তারা পালিয়েছেন। কেউ-ই আমাদেরকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি। অধ্যাপকরা আমাদের সন্তানসম দাবি করেন অথচ সেদিন সব সন্তানকে পুলিশদের লাঠি ও গুলির সামনে রেখে তারা পালিয়ে বেঁচেছেন। এমন দৃশ্য বাংলাদেশের কোথাও ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না। কীভাবে তারা আমাদের সন্তানের মতো দাবি করেন?’
ওএস/৩১ জানুয়ারি ২২