১শ ৬৩ ঘণ্টা পর আমরণ অনশন ভাঙলেন
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সমস্যার সমাধান হলো না, উল্টো গাল-মন্দ খেতে হলো। ভিসি স্যার সমাধান করবেন বলেও এগুলেন না। এরপর আমরণ অনশনে কেন যেতে হলো? সিলেটের প্রাণভোমরা ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমিন হক কেন গভীর রাতে ছুটে এলেন? তারা ও আন্দোলনের জোরালো মুখগুলোর মধ্যে কী হলো? লিখেছেন নুরুল ইসলাম রুদ্র, ছবি তুলেছেন তানভীর হাসান
মানবিক সমস্যার সমাধান হলো না
১৩ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার। রাত ৮ টায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বেগম সিরাজুন্নেসা’ হলের কটি জরুরী সমস্যা নিয়ে রিডিং রুমে করণীয় আলোচনায় বসলেন অনেকে। ছাত্রীদের হলটিতে প্রধান সমস্যাগুলো হলো-সবার থাকার সিট নেই, খাবারের মান ভালো নয়, ইন্টারনেট সংযোগে সমস্যা আছে, পানীয়জলের অভাব রয়েছে ইত্যাদি। আলাপ শেষে প্রভোস্ট সহযোগী অধ্যাপক জাফরিন আহমেদ লিজাকে ফোন করলেন একজন। সমস্যাগুলো বলতে শুরু করলেন। অভিযোগ ও দাবীদাওয়া নিজের চোখে দেখে যেতে ম্যাডামকে হলে আসতে অনুরোধ করলেন। তিনি আসবেন ‘না’ সাফ জানিয়ে দিলেন। ছাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন বলে আরো মন খারাপ হলো। মানবিক সমস্যাগুলোর সমাধান না করা ও খারাপ ব্যবহার করায় ক্ষোভে ফেটে পড়লেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে বাবা-মাকে ছেড়ে আসা হলের ছাত্রীরা।
এরপর ভিসি স্যারের দরবারে
স্বায়ত্বশাসিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ব্যক্তি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। সেদিনই রাত ১১ টা থেকে ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত তীব্র শীত ও পথে থাকার ব্যথাকে ভুলে তার বাসভবন ঘেরাও করলেন সবাই। একে, একে হল থেকে বেরুলেন একজন, একজন করে। বিক্ষোভে ক্ষণে, ক্ষণে ফেটে পড়ছে তখন তার বাসভবনের চারপাশ। কয়েকশ ছাত্রীর দাবীর কাছে মাথা নত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অথনীতি বিভাগের অধ্যাপক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ও শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি, দ্বিতীয় মেয়াদের উপাচায ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ তাদের সঙ্গে দেখা করলেন। ভালোভাবে অসুবিধাগুলো জানলেন ও আগামীকালের মিটিংয়ে বিস্তারিত জেনে সমস্যাগুলোর সমাধান করা হবে জানিয়ে দিলেন। তাদের তিনি হলে ফিরে যেতে অনুরোধ করলেন। এই ভালোবাসায় গভীর রাতে আশ্বস্ত ছাত্রীরা বিছানায় ফিরে গেলেন। ক্যাম্পাসে রাত নেমে এলো।
সমাধান কেন হলো না?
কেন যেন পরদিনের সভায় সমাধান এলো না। তাতে আবারও বিক্ষোভ শুরু করতে হলো নানা সমস্যায় জর্জরিত ছাত্রীদের। এবার তারা আর পেছনে ফিরতে রাজি নন। অযোগ্য হল প্রভোষ্ট অধ্যাপক জাফরিন আহমেদ লিজা পদত্যাগ চান। এই নিয়ে তাদের বিক্ষোভ করতে হলো কয়েকবার। তাতেও কোনো সমাধান না পেয়ে তিনদিন পর থেকে উপাচার্য স্যারের পদত্যাগের দিকে চলে গেলেন তারা। এর কারণ অতি গুরুতর-পুলিশ ক্যাম্পাসের ভেতরে এসেছে, সিলেটের পূর্ণভূমিতে ছাত্র, ছাত্রীদের ওপর হামলা করেছে! তাতে প্রশাসনের অনুমতি ও অনুরোধ ছিল। গত বুধবার দুপুরের মধ্যে উপাচার্যকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিয়ে দিলেন ছাত্র, ছাত্রীরা সবাই।
কানে নিলেন না কেন?
তবে ভিসি স্যার তাদের কথায় কান দিলেন না। তারপর বাধ্য হয়ে সেদিন বিকাল ৩টা থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ জন ছাত্র, ছাত্রী ভিসি স্যারের পদত্যাগের দাবীতে আমরণ অনশনে বসে পড়লেন। তারপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শ্লোগানে ও যন্ত্রণায় মুখরতর হচ্ছে। অনশনের আরো পাঁচজন যোগ দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রীদের এক দফা, এক দাবী-উপাচার্য স্যার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরণ অনশন চলবে। সারা দেশে ও বিশ্বের নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক ছাত্র, ছাত্রী এবং শিক্ষকরা এই বিষয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করলেন। অনেকে তাদের নানাভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে পুলিশকে ফুল দিয়ে ফিরে যেতে অনুরোধ করছেন, তারা না খেয়ে শীতের মধ্যে কোনোমতে বেঁচে আছেন-এমন সব ছবি, লেখা ও ভিডিও বক্তব্যগুলো ছড়িয়ে গেল। ওয়াকিবহাল ও প্রতিটি বিবেকবান মানুষের ভালোবাসা ও সমর্থন পেয়ে গেলেন একদল নিরন্ন তরুণ, তরুণী।
ইয়াসমিন ম্যামকে নিয়ে জাফর স্যার এলেন
২৫ জানুয়ারি বুধবার, ভোর ৪টায় নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছালেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হক। দুজনেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান অধ্যাপক। অবসরে গিয়েছেন। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের হাত ধরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারি বিভাগসহ বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগগুলোর যাত্রা। টানা ২৫টি বছর সিলেটের বিজ্ঞান শিক্ষা ও প্রযুক্তি শিক্ষার উচ্চতর প্রতিষ্ঠানটি, মহাবিদ্যালয়টির প্রাণভোমরা হয়ে শিক্ষকতা, গবেষণা করেছেন। ছাত্রছাত্রীদের নানা কাজ, আবিস্কার, উদ্যোগে প্রেরণা হয়ে থেকেছেন। যেকোনো দিক থেকে তার অবদান অসীম, কোনোদিনও ভোলা যাবে না। কথাটি জানেন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ। ড. ইয়াসমিন হক নিরবে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অনেক দান করেছেন। বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি নাম করেছেন। তবে অনেকেই জানেন না সেসব। তাদের সব সহকমী ও ছাত্রছাত্রী; শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বলেন। ভোর রাতে তীব্র শীতে প্রিয় ক্যাম্পাসে পা রেখে দেশের অন্যতম সেরা নারী শিক্ষাবিদ ড. ইয়াসমিন হক তার ছাত্র, ছাত্রী, উপস্থিত সাংবাদিকসহ সবাইকে বলেছেন, ‘আমরা ক্যাম্পাসে আসার আগে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জুমে কথা বলেছি। তাদের জানিয়েছি ও আশ্বস্ত করেছি, ভয় পেও না। আমরা কাল আসব। তবে তারা বললো, না, আপনারা আজই আসেন। ফলে দেরি না করে রাতেই রওয়ানা দিয়েছি দুজনে। ভোরে এসে পৌঁছেছি। তারা আমাদের বলেছিল আমরা এলে তারা অনশন ভাঙবে।’
জাফর স্যারের মুখোমুখি
পাশে দাঁড়ানো তার স্বামী অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন যৌক্তিক’। বাংলাদেশের প্রধান এই শিশু-কিশোর সাহিত্যিক আরো বললেন, ‘আমি অনশন ও আন্দোলনকে ভিন্নভাবে দেখি। ক্যাম্পাসে ফিরে আসার বিষয়ে আমার উদ্দেশ্য ছিল, এতগুলো মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। সেটি করতে দেওয়া যাবে না। আমি সেটি চাইনি। ছাত্র, ছাত্রীরা আন্দোলন করবে কি না তাদের ব্যাপার কিন্তু আমার মতে, তাদের আন্দোলন যৌক্তিক।’ তিনি প্রিয় ছেলেমেয়েদের বলেন, ‘আমি এখানে আসতে চাইছিলাম না। কারণ তোমরা তো আমার কথা শুনলে না। যেহেতু আমি এসেছি, তোমাদের অনশন ভাঙিয়ে তারপর আমরা এখান থেকে যাব। আমি চাই, তোমরা আন্দোলনটা চালিয়ে যাও।’ এরপর আর কোনো কথা বলেননি, বলতে পারেননি বিশ্ববিদ্যালয়টির কোনো ছাত্রছাত্রী; এমনকি আমরণ অনশনে থাকা ছেলেমেয়েদেরও মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো। জাফর স্যার এসেছেন জানার পর তাদের আর কোনো ভয়, কোনো ব্যথা ছিল না।
স্যার ও ম্যাডাম জানিয়ে দিলেন
ড. ইয়াসমিন হক এরপর জানিয়েছেন, ‘আমার মনে হয়, নামসর্বস্ব তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তবে তোমাদের স্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি ঘণ্টা গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা চাই, অনশন ভেঙে আন্দোলন চালিয়ে যাও। কেননা, তোমাদের বেঁচে থাকতে হবে।’ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন-জাফর স্যার আমাদেরকে দাবির বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের যেসব দাবি আছে, সেগুলো পূরণ করে দেয়া হবে। আমরা তাদের দুজনের কথা অসম্ভব বিশ্বাস করি বলে জাফর স্যার ও ইয়াসমিন ম্যাডামের কথাতেই আজ আমরা অনশন ভাঙছি। তারা আরো জানান, আমরা আগেই বলেছি, ভিসি স্যার পদত্যাগ না করা পযন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব। অনশন ভাঙলেও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন চলবে।
আঁধার কাটিয়ে আলো আনা হলো
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমিন হক শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়া হবে-এই আশ্বাসে, শুধু তাদের প্রিয় শিক্ষকদের কথাতেই অনশন ভাঙতে রাজি হলেন তারা। অসুস্থ হয়ে পড়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া শিক্ষাথীদের সবাইকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলেন জাফর স্যার। তাদের সবাইকে বুধবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙালেন জাফর স্যার ও ইয়াসমিন ম্যাডাম। তাদের হাতে পানি খেয়ে টানা ১শ ৬৩ ঘণ্টা বা ছয় দিন ৭৯ মিনিট পর আমরণ অনশন ভাঙলেন অসুস্থ ও ক্ষুধায় খুব কাতর ছাত্র, ছাত্রীরা। প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়া ক্যাম্পাসের অনশনকারীরা, তাদের সহপাঠীরা তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। কত কষ্ট যে হয়েছে সেসব কথা কে জানতে চেয়েছেন?
আমি খুবই গর্বিত
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘ওরা তাদের কথা রেখেছে। আমি খুবই গর্বিত যে, আমি তাদের অনশন ভাঙাতে পেরেছি। আমি ছেলেমেয়েদের ওপর সন্তুষ্ট। তারা আমার কথা রেখেছে। অনশন ভেঙেছে। তবে একটা মানুষের জন্য এত মানুষের জীবন নষ্ট করা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।’ তার ছাত্রছাত্রীরা তখন বলেছেন, জাফর স্যারের অনুরোধ ও দাবি পূরণের আশ্বাসে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থেকে কেউ সরছি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের টং দোকান বন্ধ করে দেওয়া, রাস্তা পেইন্টিও নিষিদ্ধের বিষয়ে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এগুলো থাকতে হবে। যখন থেকে বন্ধ হয়ে গেছে, তখন থেকেই বুঝতে হবে-আর যাই হোক এই উপাচার্য মহোদয় একাডেমি বোঝেন না, শিক্ষা বোঝেন না, ছাত্রছাত্রীদেরও বুঝতে পারেন না।’ তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে যাওয়ার সময় ভিসি স্যারকে একটা চিঠি দিয়েছিলাম। বলেছিলাম-এ ধরনের সুযোগ-সুবিধাগুলোও না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু চালানো যাবে না। তবে তিনি শোনেননি।’
স্যার পাশে আছেন
তিনি তার ছাত্রছাত্রীদের এই চরম আন্দোলনে সম্পূণ সংহতি প্রকাশ করেছেন, ‘তবে এই আন্দোলনটি থামানোর জন্য যে প্রক্রিয়াগুলো বেছে নেওয়া হয়েছে, সেগুলো অমানবিক, নিষ্ঠুর এবং দানবীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে পুলিশ দিয়ে ছেলেমেয়েদের ওপর আক্রমণ কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার নয়। যে ভিসি স্যারের বাসভবনের সামনে এতগুলো ছেলেমেয়ে না খেয়ে শুয়ে আছে, একবার এসেও দেখলেন না; তিনি তো কখনো ভিসি হতে পারেন না। সব উপাচার্যকেই শিক্ষার্থীদেরকে নীচভাবে দেখবেন না-বলতে চাই। তিন বছর আগে অবসরে যাওয়ার সময় উপাচার্য মহোদয়কে আমার ওই চিঠিতে আরো বলেছিলাম, ‘ছাত্র, ছাত্রীদের কখনো অবহেলা করবেন না, তাহলে ওদের ভেতরে যেসব ক্ষোভ আছে, সেগুলো বিক্ষোভে রূপ নেবে।’ অক্ষরে, অক্ষরে আমার কথা ফলেছে। আমি তো এই বিশ্ববিদ্যালয়কে চিনি। আজকের এ আন্দোলন আসলে গত তিন বছরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ।”
সবাই আমার ছেলেমেয়ে
হাতের তালুর মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়কে চেনা-শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলার প্রধান কারিগর ও মুখপাত্র ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এই আন্দোলনে বহিরাগতরা আছে কিনা সাংবাদিকদের এই প্রশ্নেরও জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যারা আন্দোলন করছে, একেবারেই সাধারণ ছেলেমেয়ে। সঙ্গত কারণেই ওরা আন্দোলন করছে। পুলিশ তাদের উপর হামলা করেছে, তাই পরেও তারা আন্দোলনটি করছে। তাদের এসব দাবি যৌক্তিক। ছাত্রদের উপর এ বর্বর হামলা খুবই খারাপ উদাহরণ। অন্যায় ও ববরতা। তাদের উপর যখন পুলিশ হামলা চালিয়েছিল, তখন শিক্ষকদের সবার উচিত ছিল-ছাত্রছাত্রীদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া; তারা সেটি করতে পারেননি। শিক্ষকদের আরো বেশি দায়িত্বশীল হওয়ার জন্য আমি অনুরোধ করি।’
আমি ছাত্র, ছাত্রীদের টাকা দিলাম
আন্দোলন করে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের টাকা দিয়ে সহযোগিতা করায় পাঁচ সাবেক শিক্ষার্থীকে ঢাকা থেকে সিআইডি গ্রেপ্তার করেছে। তাতে আরো ক্ষেপে গিয়েছেন জাফর স্যার। আন্দোলনকারীদের তিনি নগদ ১০ হাজার টাকা দিয়ে বলেছেন, ‘আজকে ওদের টাকা দিয়ে সাহায্য করায় পুলিশ আটক করেছে; আমি ছাত্র, ছাত্রীদের টাকা দিলাম। আমাকেও গ্রেফতার করা হোক।’ আথিক সাহায্যদাতাদের খবর ক্যাম্পাসে দিয়ে জাফর স্যার বলেন, ‘তাদেরকে কোর্টে ওঠানো হবে ও জামিন দেয়া হবে। তাদেরকে আর কখনো থানায় আসতে হবে না-উচ্চতর মহলের ব্যক্তিবর্গ আমাকে এই কথা দিয়েছেন।’ আন্দোলনরত ছাত্র, ছাত্রীদের ওপর পুলিশের অন্যায় হামলার প্রতিবাদ করে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘আমাদের ২-৩শ জনের বিপক্ষে মামলা হয়েছে। যখন প্রয়োজন হবে তখন একজন একজন করে জেলখানায় ঢুকানো হবে। সেটি ঘটতে দেওয়া যাবে না। আমি আশা করব, পুলিশ ও প্রশাসন খুব দ্রুত মামলা প্রত্যাহার করে নেবেন। আমার সাথে সরকারের উচ্চতর মহলের এই নিয়েও কথা হয়েছে। তারাও কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছেন। তারা আমাকে যেসব কথা দিয়েছেন, সেগুলো যেন পালন করেন সেই অনুরোধ করব।’ এরপর বাংলাদেশের অন্যতম সেরা এই শিক্ষাবিদ জানিয়েছেন, ‘তারা যদি কথাগুলো না রাখেন, তাহলে আমি মনে করবো-তারা শুধু আমার সাথে নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি প্রগতিশীল মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। আমি আরো আশা করি, সরকারের মাধ্যমে আমাদের সকল মামলা প্রত্যাহার করা হবে। কাউকে হয়রানি করা হবে না।”
চিকিৎসক নেই কেন?
অনশনস্থলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল টিম না থাকা প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি ধরে নিয়েছিলাম, এখানে মেডিক্যাল টিম আছে। তারা সার্বক্ষণিক দেখভাল করছেন কিন্তু এসে জানলাম, ডাক্তাররা এখানে ছিলেন। তাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। ছাত্র, ছাত্রীদের শরীরের অবস্থা এত খারাপ হলে আরো অসুস্থ ২০টি ছেলেমেয়ের কী অবস্থা? আমি খুব শঙ্কিত। এ তো চরম অমানবিকতা।’
ভিসি সাহেবের পদত্যাগ দেখার খুব শখ ছিল
একযোগে দেশের ৩৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করার বিষয়ে জাফর স্যার বলেছেন, ‘উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ সাহেব পদত্যাগ করলে দেশের ৩৪ জন ভিসি একসঙ্গে পদত্যাগ করবেন বলেছিলেন; আমার দেখার খুব শখ ছিল। আমার ধারণা সে শখ সহজে মিটবে না। এখন তো তাদের সবার ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা তোমরা টের পাচ্ছ না-তোমরা কী করেছ? সারা বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে নাড়া দিয়ে দিয়েছ। তোমাদের এই আন্দোলনে বাংলাদেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মডিফিকেশন হয়েছে। জানি না সেটি আমি দেখে যেতে পারব কি-না।’
চাষাভূষার টং
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের টং দোকান, খাবারের সামান্য দোকান, ফুডকোর্ট, ক্যান্টিন, ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ করে দেয়ায় শিক্ষার্থীরা খাবারের দোকান চালু করতে বাধ্য হয়েছেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আচরণে নিয়ে মন্তব্য করার সময় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অধ্যাপক নিজেকে বুদ্ধিজীবী বলে জানিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমরা চাষাভূষার সন্তান নই যে যাচ্ছেতাই বলবে।’ তার বক্তব্যের প্রতিবাদে ছাত্রছাত্রীরা দোকানটির নাম দিয়েছেন ‘চাষাভূষার টং’। গতকাল সারাদিন চাষাভূষার টং দোকানে ছিল ছাত্র, ছাত্রীদের মুখর পদচারণা। তারা পাউরুটি, কলা, চা, খিঁচুড়ি, বিরিয়ানিরও ব্যবস্থা করেছেন।
জাফর স্যারের ক্যাম্পাস
উত্তাল এই ক্যাম্পাসে আবার ফিরেছে নিরবতা। ছাত্রছাত্রীদের সবাই ক্লান্ত, অনেকে হলে। অনশন ভাঙার পর হাসপাতাল ছেড়ে আসা কয়েকজন বুধবার বিকেলেই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। অন্যদের সঙ্গে ফিরেছেন। মেস ও হলে ফিরে যাচ্ছেন তারা একে, একে। যাদের শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি-বলেছেন আন্দোলনের বন্ধুরা। হাসপাতাল থেকে হলে ফেরা জান্নাতুল নাঈম নিশাত বলেছেন,‘ জাফর স্যারের প্রতি আমাদের অগাধ বিশ্বাস ও সম্মান। তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন তাই স্যারের কথায় অনশন ভেঙেছি। হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়েছে। তবে আমার শরীর ভালো নয়। হলে থেকে ডাক্তারের ঔষধ খেতে হবে।’ জাহিদুল ইসলাম অপূর্ব বলেছেন,“যার কাছে আমরা নিরাপদ নই, আমরণ অনশনের এই ২৮ জন ছাত্রছাত্রীর প্রাণগুলোও মূল্যহীন; তার মতো ‘নির্লজ্জ’ ভিসি স্যারকে আমাদের ক্যাম্পাসে আর চাই না। আমরা এই ভিসি স্যারের হাত থেকে থেকে মুক্তি চাই।” ছাত্রছাত্রীরা জানিয়েছেন, তারা আগের কথা অনুসারে উপাচার্যের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত নানা কর্মসূচি দেবেন ও আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
ওএস/২৬-১-২০২২।