জাফর ইকবালের হাতে পানি খেয়ে অনশন ভাঙল শিক্ষার্থীরা
মন্ত্রীও পারলেন না কিন্তু পারলেন যিনি তিনি সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। তাঁর প্রিয় শিক্ষার্থীরা রাখলেন কথা। ভাঙলেন অনশন। আজ বুধরার (২৬ জানুয়ারি) সকাল ১০টা ২০ মিনিটে অনশন ভাঙেন তারা।
এর আগে ২০ জন অনশনকারী ছিলেন হাসপাতালে। পরে সবাইকে হাসপাতাল থেকে অনশনস্থলে আনা হলে পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙ্গান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হক। সকাল ৮টায় অনশন ভাঙ্গার কথা থাকলেও হাসপাতাল থেকে তাদের আনতে বিলম্ব হওয়ায় অনশন ভাঙতেও বিলম্ব হয়। তবে প্রিয় শিক্ষকের হাতে পানি পান করে অনশন ভাঙায় আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনশকারী শিক্ষার্থীরা।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান। তিনি বরাবরই শাবিপ্রবিকেই তার প্রিয় ক্যাম্পাস মনে করেন। তাই বুধবার ভোররাতে প্রিয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হক। ৪টা ১০ মিনিট থেকে ৫টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত বসে শুনলেন প্রিয় শিক্ষার্থীদের কথা। পরে আবার টানা এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কথা। অবশেষে সোজা কথা। অনশন ভাঙতে হবে৷ হাসপাতালে যারা আছেন তাদের আনাও। সকাল ৮টায় এক সঙ্গে সবাই অনশন ভাঙব। তাতে সবাই সম্মত হন।
ভোর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিক্ষার্থীদের মুখ থেকে অনশনরতদের চিকিৎসা সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার কথা শুনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বলেন, ‘আমি আশ্বস্ত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম চিকিৎসা সহায়তা থাকলে বাচ্চারা অন্তত কিছুটা সুস্থ থাকবে। কিন্তু এসে দেখলাম ভিন্ন। এটা অমানবিক।’
আন্দোলনকারীদের খাবার সহায়তার জন্য অর্থ দেওয়ায় সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এতেও ক্ষুব্ধ এই অধ্যাপক। নগদ ১০ হাজার টাকা শিক্ষার্থীদের হাতে দিয়ে বলেন, ‘হয়তো এটা এমন কোনো টাকা না। এটা দিয়ে বেশি কিছু হবে না। আমি দেখতে চাই সিআইডি এসে আমাকে এরেস্ট কিরে কি না।'
মামলার ব্যাপারে তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘সরকার থেকে আমাকে কথা দেওয়া হয়েছে সকল মামলা প্রত্যাহার করা হবে এবং কাউকেই হয়রানি করা হবে না। গ্রেপ্তার পাঁচজনকেও জামিনের ব্যবস্থা করা হবে।’
জাফর ইকবাল বলেন, ‘সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের একজন আমাকে বলেছে, আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি কোনো সাবেক শিক্ষক প্রবেশ করতে চায় তাহলে অনুমতি লাগে। আমি পারমিশন ছাড়া ঢুকে গেছি। আইন ভেঙ্গেছি নিশ্চয়ই। আমি দেখতে চাই আমাকে শাস্তি দেওয়া হয় কি না।’
শুনলাম বাংলাদেশের ৩৪ জন উপাচার্য এক সঙ্গে পদত্যাগের হুমকির বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি দেখতে চাই যে আমাদের দেশে এমন ভিসি আছে যাদের আদর্শ এতো বেশি যে উনারা অন্যের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে পদত্যাগ করবেন।’
এর আগে ১৩ জানুয়ারি সিরাজুন্নেছা ছাত্রী হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক জাফরিন লিজার পদত্যাগ দাবিতে শুরু হয় ছাত্রী আন্দোলন। এই দাবিতে ১৬ জানুয়ারি আইআইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রাখলে সন্ধ্যায় ঘটে তুলকালাম কাণ্ড। সে সময় উপাচার্যকে উদ্ধারকে কেন্দ্র করে পুলিশের লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের ঘটনায় আহত হন অর্ধশত শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ উপদেষ্টা ও পুলিশের কয়েকজন সদস্যও আহত হন। এর পর থেকেই শুরু হয় উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন। গ্রহণ করা হয় গণস্বাক্ষর। দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতি বরাবর খোলা চিঠি। পরে গত ১৯ জানুয়ারি বুধবার থেকে শুরু হয় অনশন।
অনশনের প্রথম দিন থেকে দফায় দফায় শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এরই মাঝে শিক্ষকদের একাংশ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে করেন মানববন্ধন। তবে সোমবার আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে আলোচনার চেষ্টা শুরু করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল।
মঙ্গলবার রাতে বুধবার ১২টার মধ্যে উপাচার্যকে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দেয় শিক্ষার্থীরা। অন্যথায় আমরন অনশনের ঘোষণা দেয় তারা। উপাচার্য পদত্যাগ না করায় বুধবার (১৯ জানুয়ারি) বেলা ২টা ৫০ মিনিটে আমরণ অনশন শুরু করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে শুক্রবার (২১ জানুয়ারি) শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির আলোচনার বার্তা নিয়ে আসেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। ওইদিন বিকাল ৩টায় মুঠোফোনে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আলাপ করিয়ে দেন নাদেল। এ সময় শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার্থীদের আলোচনার জন্য প্রতিনিধি দল ঢাকায় পাঠানোর প্রস্তাব দেন৷ শিক্ষামন্ত্রীর প্রস্তাবে প্রথমে সম্মত হলেও পরে ঢাকায় না এসে অনলাইনে আলোচনার আহ্বান জানান।
পরে শিক্ষার্থীরা ঢাকায় না আসলেও শুক্রবার রাতে শাবিপ্রবি শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। শনিবার সন্ধ্যায় শিক্ষকদের বৈঠকের পর ওইদিন রাত ১টায় অনলাইনে শিক্ষার্থীদের আলোচনা হয়। এ সময় শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার্থীদের অনশন ভেঙে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের প্রস্তাব দিলে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিতে অনড় থাকেন। এর প্রেক্ষিতে রবিবার (২৩ জানুয়ারি) দুপুরে ফের শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আলোচোনায় বসার কথা থাকলেও তা আর হয়নি। এর মধ্যেই শনিবার রাতে গণঅনশনের ঘোষণা দেন আন্দোলকারীরা। এতে আরও পাঁচ শিক্ষার্থী অংশ নেন।
এসইউ/এসআইএইচ