প্রকৌশলী-ঠিকাদারের দুর্নীতি
তিন বছরেরই ঝুঁকিপূর্ণ ভোলা সরকারি কলেজ
প্রকৌশলী ও ঠিকাদারের দুর্নীতির কারণে ভোলা সরকারি কলেজে নবনির্মিত পাঁচ তলা বিশিষ্ট চারতলা ‘একাডেমিক ভবন কাম এক্সামিনেশন হল’ পরিত্যক্ত ঘোষণা হচ্ছে। ২০১৯ সালে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি’র) প্রকৌশলীরা ভবনটির চারতলা ছাদকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল। কারণ ভবনটির পলেস্তারা খসে পড়ছে। ভবনটির কাজের মান এতই খারাপ সেখানে পাঁচ তলা করতে গেলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা করছেন কলেজ শিক্ষকরা। যদিও ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার বিষয়টি কলেজ কর্তৃপক্ষকে এখন পর্যন্ত অবহিত করেনি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। তবে পুরো ভবনের কাজ শেষ না করেও বিল ঠিকই বাগিয়ে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
ইইডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার বছর আগে নির্মিত ভবনটির চারতলা ছাদে নির্ধারিত মাপের চেয়ে কম রড ব্যবহার করা হয়েছে। ছাদের থিকনেস ড্রইংয়ের থিকনেস থেকে কম। এতে ছাদে জোরে চলাফেরা করলে শব্দ সৃষ্টি হয়। এসব কারণে ছাদটিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ অভিহিত করা হয়েছে। ওই ভবনে লিফট স্থাপন করা যাচ্ছে না। ভবনটি সংস্কার করতে প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৪ কোটি টাকা লাগবে বলে জানিয়েছেন ইইডি’র এক প্রকৌশলী।
২০১৫ সালে ভোলা সরকারি কলেজের ভবনটির পাঁচতলা ভিতবিশিষ্ট প্রথম তিনতলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজটি সম্পন্ন করে হস্তান্তর করা হয়। এরপরই ভবনটির নিম্নমানের নির্মাণ কাজ চিহ্নিত হয়। গুরুতর অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে ইইডি কর্তৃপক্ষ উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে। ওই বছর ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজের ৪র্থ তলার ছাদ ঢালাই সম্পন্ন হয়। ইইডির পরিদর্শন ও তদন্ত কমিটি ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর একটি প্রতিবেদন জমা দেয়, যাতে নির্মাণ কাজে বড় ধরনের অনিয়ম শনাক্ত হয়।
অন্তত তিনবার ওই ভবনটির নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করেন ইইডির প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞ ডিজাইনার জয়নাল আবেদীন।
তিনি বলেন, ‘ভবনটিকে পাঁচতলা করা যাবে না। চারতলার ছাদসহ আরও কিছু সাইড ভেঙ্গে নতুন করে পিলার দিয়ে করতে হবে। এতে এতে তিন থেকে চার কোটি টাকা ব্যয় হবে। আমি ভবনটি পরিদর্শন করে কয়েকটি টেস্ট দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো রিপোর্ট হয়েছে কি না আমার জানা নেই।’
এ ব্যাপারে ভোলা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. গোলাম কিবরিয়া ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘একই অবস্থায় আছে। মন্ত্রণালয় তদন্ত করছে যেহেতু তাদের টিম কাজ করছে এখানে আমাদের মতামত চেয়েছে কি অবস্থায় আছে। এটা কি অবস্থায় আছে এটা ভালো না মন্দ এ বিষয়ে অধিদপ্তর থেকে বা মন্ত্রণালয়কে থেকে আমাদের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। শুনেছি এটা হয়তো তদন্ত নিচ্ছে। আমি প্রত্যাশা করেছিলাম মন্ত্রণালয় অধিদফত আমার একটা সিদ্ধান্ত জানতে চাইবে কিন্তু কেউ তা করেনি।
জানা গেছে, ভোলা কলেজের ভবন নির্মাণের সময় ইইডির ‘ভোলা অঞ্চল’র নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন দেলোয়ার হোসেন মজুমদার। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক (ডিপি) মামলা করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের শেষ দিকে তাকে মাফ করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি তাকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি ইইডির চট্টগ্রাম সার্কেল প্রধানের দায়িত্বে আছেন।
দেলোয়ার হোসেন মজুমদারের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর। ভোলা কলেজে নির্মাণ কাজে দুর্নীতির বিষয়ে সম্প্রতি আরেকটি তদন্ত কমিটি করেছিল সাবেক শিক্ষা সচিব মাহবুব হোসেন। কিন্তু একটি প্রভাবশালী মহলের চাপে এবার দায়সারাগোচের একটি প্রতিবেদন জমা হয়েছে, যাতে দেলোয়ার হোসেনের দায় চাপানো হয়েছে একজন মৃত ডিপ্লোমা প্রকৌশলী এবং আরেকজন কনিষ্ঠ কর্মকর্তার ওপর।
এ বিষয়ে দেলোয়ার হোসেন মজুমদার ঢাকা প্রকাশকে বলেন, ‘তখন কি হয়েছিল সে বিষয়ে আমার কিছুই মনে নাই। আমার কোভিড হওয়ার পর কোন কিছুই মনে নাই। তবে একটা ভবন কি শুধু একজন নির্বাহী প্রকৌশলী করে? অন্য যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদেরকেও জিজ্ঞেস করেন।’
ওই ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল ‘৭০ পোস্ট গ্রাজুয়েট’ কলেজ প্রকল্পের আওতায়। ওই প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) অধ্যাপক নাসির উদ্দিন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘এটা তো অনেক আগের কথা। তখন অভিযোগ ওঠার পর একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই তদন্ত প্রতিবেদন পেলেই হয়তো কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’
এক অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ‘দেলোয়ার হোসেন মজুমদার কুমিল্লা জেলার সহকারী প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় ২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তাকে ভোলা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্ব দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু ওই আদেশে আটজন কর্মকর্তা নতুন কর্মস্থলে যোগদান করলেও দেলোয়ার হোসেন যোগদান করেননি। তিনি ২০১১ সালের জুন মাসেও কুমিল্লা জেলার সকল উন্নয়ন কাজের বিলে স্বাক্ষর করেন এবং সকল দাপ্তরিক কাজে (কুমিল্লা) তার স্বাক্ষরের কাগজপত্র বিদ্যমান আছে। ২০১১ সালের ১৪ জুলাই পর্যন্ত কুমিল্লা জোনের যাবতীয় কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন তিনি।
অন্যদিকে সেই সময়ে ভোলা জোনের দায়িত্বে থেকে ইউনুস আলী ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত উন্নয়ন কাজের সকল বিল প্রদানসহ দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা করেন। দেলোয়ার হোসেন তালুকদার ওই সময়ে ভোলা জোনের কোনো বিলে স্বাক্ষর করেননি বা তার স্বাক্ষরে কোনো বিল পাশ হয়নি। অথচ তিনি অসততার আশ্রয় নিয়ে পুরোনো তারিখে ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যোগদানপত্র দাখিল করেন।
এসএম/এমএমএ/এসএ/