শিল্পী কামরুল হাসান স্মরণে জাতীয় জাদুঘরে সেমিনার ও আলোচনা
উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী কামরুল হাসান। শুধুমাত্র শিল্পচর্চার ভেতরেই নিজেকে সীমাবদ্ধ থাকেননি এই পথিকৃৎ চিত্রকর। তিনি ছিলেন সামাজিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে দায়বদ্ধ একজন শিল্পী। সেই অর্থে জনসম্পৃক্ত এক শিল্পীর নাম কামরুল হাসান। ভারতীয় উপমহাদেশের তাঁর মতো এমন জনসম্পৃক্ত শিল্পী আর একজনও পাওয়া যায় না। ছবি আঁকার পাশাপাশি নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়ে অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়ও সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। এ গুণী শিল্পীর জন্মশতবার্ষিকী পালন উপলক্ষ্যে জাতীয় জাদুঘর আয়োজন করে সেমিনার ও আলোচনা।
শনিবার (৪ ডিসেম্বর) কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আয়োজিত সেমিনার ও আলোচনার শিরোনাম ছিল ‘কামরুল হাসান: ঐতিহ্যানুরাগী আধুনিক শিল্পী’। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি সচিব আবুল মনসুর। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও সভাপতি ড. সৈয়দ আজিজুল হক। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজ -এর সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডীন অধ্যাপক নিসার হোসেন। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। সঞ্চালনা করেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান এনডিসি।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ড. সৈয়দ আজিজুল হক মহৎ শিল্পী কামরুল হাসানের জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরেই যে-নামটি সর্বাধিক গুরুত্বসহকারে উচ্চারিত হয় সেটি হল কামরুল হাসান। আমৃত্যু বাঙালিত্বের সাধনা, দেশাত্মবোধ ও নির্ভীক সত্য উচ্চারণের একনিষ্ঠায় মহিমান্বিত হয়েছে তাঁর জীবন। তাঁর সৃষ্টির জগৎও দেশের মৃত্তিকাসংলগ্ন, ঐতিহ্যস্পর্শী ও আধুনিকতামণ্ডিত। তাঁর সংস্কৃতিভাবনার সঙ্গে সার্থক রাজনীতিচিন্তা যুক্ত হয়ে তাঁর শিল্পসাধনাকে মানবতার সমার্থক করে তোলে। তাঁর কাছে আধুনিকতা মানে লোকজীবনের সঙ্গে, লোকসমাজসৃষ্ট শিল্পের সঙ্গে, আরো লগ্ন হওয়া; ওই শিল্পের অন্তর্গত ঐতিহ্যিক রসকে সমকালীন বোধের সঙ্গে জারিত করে নতুনভাবে উপস্থাপন করা। কামরুল হাসান সেটাই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আয়ত্ত করে প্রকৃত অর্থে আধুনিক হয়ে উঠেছেন।
অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, শিল্পী কামরুল হাসান এমন একজন শিল্পী ছিলেন যিনি বাংলার শ্রেষ্ঠত্ত্ব তুলে ধরেছেন। প্রতিটা ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনুপ্রাণিত করতো। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তাই তিনি করতেন। তাঁর বড়ো কৃতিত্ব হলো তিনি বাংলাদেশের লোকশিল্পের সঙ্গে আধুনিক শিল্পরীতির সার্থক সমন্বয় করেছিলেন। বাঙালি নারীর বিচিত্র রূপ ও ভঙ্গিমাকে তিনি নানাভাবে এঁকেছেন। তাঁর শিল্পবৈশিষ্ট্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তিনি তেলরং ও জলরঙসহ উভয় মাধ্যমে কাজ করেছেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আবুল মনসুর বলেন শিল্পী কামরুল হাসান সত্য অনুসন্ধানের কাজ করেছেন। রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি আধুনিক শিল্পী হতে পেরেছেন। এজন্য তাঁর চিত্রকর্মে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কে এম খালিদ বলেন, বাংলার এই ক্ষণজন্মা চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের চিত্রকর্মে লৌকিকতা ও আধুনিকতার মিশ্রণ ঘটেছে। তিনি 'পটুয়া কামরুল হাসান' নামেই বেশি পরিচিত। চিত্রকলার মাঝেই তিনি মায়াময় অপূর্ব এক মিশ্রণ তৈরি করে রেখে গেছেন তরুণ প্রজন্মের জন্যে।
সভাপতির ভাষণে অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, শিল্পী কামরুল হাসান মহান মুক্তিযুদ্ধ ও শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি সত্যের সৈনিক ছিলেন, সবসময় সত্যের সন্ধান করেছেন। তাঁর শিল্পকর্মে যেমন ফুটে উঠে বাংলার নানা দৃশ্য তেমনি ফুটে উঠে সংগ্রামী চেতনা।