‘মাসুদ রানা’র স্রষ্টা কে?
সেবা প্রকাশনী’র কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেন মারা গেছেন। বুধবার (১৯ জানুয়ারি) বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটে তিনি রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিংবদন্তি এই লেখকের মৃত্যুতে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বেশ আলোচনায় আসে সেবা প্রকাশনীর তুমুল জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ ‘মাসুদ রানা’র স্রষ্টা ও স্বত্ব প্রসঙ্গটি।
সম্প্রতি ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০ ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে মালিকানা স্বত্ব শেখ আবদুল হাকিমের বলে রায় দিয়েছে উচ্চ আদালত। গত ১৩ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করে।
মাসুদ রানা সিরিজের বইয়ের স্বত্ব নিয়ে আইনি লড়াইয়ের মধ্যে রায়ের মাস চারেক আগে গত আগস্টে না ফেরার দেশে চলে যান জনপ্রিয় থ্রিলার লেখক শেখ আবদুল হাকিম। আর রায়ের মাস খানেক পর বিদায় নিলেন সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেন।
সেবা প্রকাশনীর ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০ ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে মালিকানা স্বত্ব শেখ আবদুল হাকিমকে দিয়েছিল কপিরাইট অফিস।
২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ‘মাসুদ রানা’ ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের কিছু বইয়ের বিষয়ে কপিরাইট অফিসের দেওয়া আদেশ এক মাসের জন্য স্থগিত করে হাইকোর্ট।
আদেশে কপিরাইট অফিসের এ সিদ্ধান্ত কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেছিল আদালত।
কপিরাইট অফিসের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের করা এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দিয়েছিল।
২০২০ সালের ২৯ জুলাই শেখ আব্দুল হাকিম ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০টি এবং ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে স্বত্ব দাবি করে সেবা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে কপিরাইট আইনের ৭১ ও ৮৯ ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ দাখিল করেন।
তুমুল জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ ‘মাসুদ রানা’। এই বিখ্যাত সিরিজটির লেখক হিসেবে পরিচিত কাজী আনোয়ার হোসেন। সবাই তাই জানতও। কিন্তু শেখ আবদুল হাকিম নিজেকে এই সিরিজের অধিকাংশ বইয়ের লেখক হিসেবে দাবি করে কপিরাইট আইনে মামলা করেন। দীর্ঘ প্রায় এক বছরের আইনি লড়াই শেষে গত ১৪ জুন বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস এই মামলায় আবদুল হাকিমের পক্ষে রায় দেয়।
এতে বলা হয়, গোয়েন্দা সিরিজ মাসুদ রানার প্রথম ১১টি বইয়ের পরের ২৬০টি বইয়ের লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন নন। এর লেখক শেখ আবদুল হাকিম।
কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী বলেছিলেন, শেখ আবদুল হাকিমের দাবিকৃত ২৬০টি মাসুদ রানার বইয়ের মধ্যে একটি এবং কুয়াশার ৫০টি বইয়ের মধ্যে ছয়টিতে লেখক হিসেবে তার নামে কপিরাইট করা আছে। বাকিগুলোর কপিরাইট করা নেই। তবে সেগুলো তার লেখা এটা তিনি প্রমাণ করেছেন।
জানা গেছে, গত বছরের ২৯ জুলাই শেখ আবদুল হাকিম অভিযোগ করার পরে অভিযোগকারী ও প্রতিপক্ষের আইনজীবীর উপস্থিতিতে ওই বছরের ১১ ও ৩০ সেপ্টেম্বর এবং ৪ নভেম্বর শুনানি হয়। আদালতে উভয়পক্ষ তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করে। দাখিলকৃত অভিযোগের বিষয়ে প্রতিপক্ষ লিখিত বক্তব্য দাখিল করেন। প্রতিপক্ষের ওই লিখিত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাদী পুনরায় নিজের পক্ষে লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করেন। পরে অভিযোগকারীর দাখিলকৃত যুক্তির বিষয়ে প্রতিপক্ষ পুনরায় লিখিত যুক্তিতর্ক পেশ করেন।
জটিল এই বিষয়টির এবং দেশের প্রকাশনা শিল্পের ক্ষেত্রে লেখক ও প্রকাশকের পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্ব বিবেচনা করে এর সন্তোষজনক ও সুষ্ঠু সমাধানের উদ্দেশ্যে অভিযোগের বিষয়ে দেশের বিখ্যাত ও প্রথিতযশা কয়েকজন লেখক ও প্রকাশক এবং সেবা প্রকাশনীর সাবেক ব্যবস্থাপকের লিখিত মতামত চাওয়া হয়। যাদের মধ্যে ছিলেন লেখক বুলবুল চৌধুরী ও শওকত হোসেন, প্রখ্যাত শিল্পী হাশেম খান এবং সেবা প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক ইসরাইল হোসেন খান। তাদের লিখিত মতামতের ওপর ভিত্তি করেই কপিরাইট অফিস ওই রায় দেয়।
এ প্রসঙ্গে কাজী আনোয়ার হোসেন বক্তব্য হচ্ছে : `এ কথা তো আমি বহুবার বলেছি, কোনো দিন গোপন করিনি যে, সবগুলো মাসুদ রানা সিরিজের বই আমি লিখিনি। সাক্ষাৎকারে বলেছি। এখানে অভিযোগ আসার কোনো সুযোগই নেই। আমার ছোট ভাই এবং দুই ছেলেও মাসুদ রানা সিরিজের বই লিখেছে। সিলেটের একজন চিকিৎসক ছিলেন, তিনিও লিখেছেন। আমি তো সবার সামনেই বলেছি, আমার পক্ষে সবগুলো লেখা সম্ভব হচ্ছে না। আমি কাহিনী সাজিয়ে দিচ্ছি, কাহিনীটা আমার।'
বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন, ‘বিদেশি বিভিন্ন কাহিনী, যা আমার মাসুদ রানা সিরিজের সঙ্গে মেলে, সে ধরনের কাহিনী আমি নিজেই বাছাই করি। ইংরেজি সাত-আটটা বই থেকে ধারণা নেই যে এই ধরনের কাহিনী হতে পারে। এরপর সেই অনুযায়ী আমি প্লট সাজাই। এরপর আমি বিভিন্ন লেখকদের সঙ্গে আলোচনা করি, এই প্লটে আমি গল্প লেখাতে চাই। কারণ, আমার সময় হবে না। যার যেটা ভালো লাগে তিনি সেটা নেন। আমার ছেলে লেখে। আমার প্রয়াত ছোট ভাই মাহবুব হোসেন লিখত। শেখ আব্দুল হাকিম লিখেছেন। বিচিত্রা সম্পাদক প্রয়াত শাহাদত চৌধুরীও লিখেছেন।’
শেখ আবদুল হাকিম কখনো ‘মাসুদ রানা’র স্রষ্টা হিসেবে দাবি করেননি। তবে দাবি করেছেন, তিনি ‘মাসুদ রানা’ লেখার পর থেকেই এটি জনপ্রিয়াতা পায়।
শেখ আবদুল হাকিমের বক্তব্য : ‘১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে চিত্রশিল্পী হাশেম খান আমার বড় ভাই রহমানকে বই লেখার প্রস্তাব দিলে তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। হাশেম খান ‘কুয়াশা’র একটি গল্প বলে দেন। আমি এক রাতে লিখে ফেলি। এটি কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেব পছন্দ করেন। আমার ভাইয়ের মাধ্যমে আমাকে ১০০ টাকা দেওয়া হয়। এরপর আমাকে নিজেই কাহিনী তৈরি করে ‘কুয়াশা’ সিরিজের বই লিখে দিতে বলা হয়। ১৯৭০ সালের দিকে মাসুদ রানা সিরিজের বই আমাকে লিখতে বলা হয়। আমি লেখা শুরু করার পরই এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার কপি পর্যন্ত ছাপা হতে থাকে একেকটি বই। তখন আমি রয়ালটি হিসেবে টাকা দাবি করি। দেখা গেল, একেকটি বইয়ের জন্য সাত হাজার টাকা আমার পাওনা। কিন্তু অর্ধেক টাকার বেশি আমাকে দেওয়া হয় না। আবার বলা হলো, রয়ালটি পাব মাত্র চার বছর। এটা কাজী সাহেবের নিজের তৈরি আইন। এটা আর কোথাও নেই।’
এমএ/এপি/