কোরআনে ইসলাম প্রসঙ্গে একটি সর্বজনীন বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি
ড. মুহম্মদ এমদাদ হাসনায়েন
বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী রুহুল আযম কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর শিলাইদহের পাশে কালোয়া গ্রামে জন্ম। তিনি অতি ছোটবেলা থেকে সত্যানুসন্ধানী। ১৯৬৯’র গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ভারত গমন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ। লেখালেখির অভ্যাস স্কুল জীবন থেকে। ইতোমধ্যে ‘সবুজ নিসর্গের দাহ’ নামক একটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে এবং ‘নিন্দিত সময়ের নন্দিত উপাসনা’ নামক একটি কাব্যগ্রন্থ পাণ্ডুলিপি আকারে বেরিয়েছে। কোরআন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গি শ্রেণি বিভাজন এবং বক্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে তার ভাষা অকপট ও তীক্ষ্ণ।
প্রকৌশলী রুহুল আযম ‘কোরআনে ইসলাম প্রসঙ্গে একটি সর্বজনীন বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি’ গ্রন্থটি কণ্ঠধ্বনি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ১৬০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি ২০২৩ সালের গ্রন্থ মেলায় প্রকাশিত হবে। এই গ্রন্থটি তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়ে মানব সৃষ্টি সম্পর্কে বিজ্ঞান-দর্শন ও বিভিন্ন ধর্মমত সমূহের আলোকে আলোচনা। প্রথম অধ্যায়টি বক্তব্যের বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে কয়েকটি অনুচ্ছেদে বিভক্ত এবং প্রত্যেকটি অনুচ্ছেদের শেষে অনুচ্ছেদের মূল বক্তব্য-বিষয়কে অনুসিদ্ধান্ত আকারে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আল-কোরআনের আয়াত সমূহের আলোকে নবী করিম (সঃ) এর কর্তব্য বা কাজ সমূহের বিবরণ আল-কোরআনের বিভিন্ন সুরা থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে আল-কোরআনের নির্বাচিত কিছু আয়াত, যেগুলোকে আল-কোরআনে আল্লাহতালা ফুরকান নামে অভিহিত করেছেন। গ্রন্থটির একটি বৈশিষ্টের কথা এখানে উল্লেখ করতে হয়, যেটি আমার নিজস্ব ধারণা মতে সৃষ্টিশীল নতুন চিন্তার ফসল যেমন- সভ্যতার শুরু থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন স্তর অতিক্রমের মাধ্যমে সভ্যতার যে ক্রমোন্নতি হয়েছে, ভিত্তি হিসাবে তার মূলে রয়েছে মানুষের সৃষ্টিশীল মেধা বা জ্ঞান যেটা যুগে যুগে সৃষ্টিশীল মানুষের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার নিজের দেওয়া। মানুষের সঙ্গে স্রষ্টার যোগাযোগ হয় মানুষের সৃজনশীল চিন্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সকল মানব সদস্যের জন্ম হয় আলাক স্তরে যখন প্রতিটি মানব সদস্যের ব্রেইন থাকে অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক জন লকের ট্যাবুলা রাসা বা শূন্য শ্লেটের মত এবং এই আলাক স্তর থেকে বেছে নিয়ে আল্লাহতালা যুগে যুগে তাঁর পরিকল্পনা ও প্রয়োজন অনুসারে শারিরীক-মানসিক যোগ্যতা সহকারে একেক জন ইনছান মানুষ সৃষ্টি করেন। সেজন্য জাতি, স্থান-কাল, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানব শিশুকে সর্ব্বোচ্চ ছয় বছর বয়স পর্যন্ত আল্লাহতালা নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেন। সমুদ্র প্রবাহের মতো মানব প্রবাহের দুইটি ধারা রয়েছে যার একটি প্রগতিপন্থী এবং অপরটি প্রগতিপরিপন্থী, এটিও আল-কোরআনের অন্যতম শিক্ষা। সুরা ফাতিহার শেষ অংশের অর্থ হতে হবে আরও বিস্তৃত ও উদার এবং তাহলেই মুসলিম জাতির দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিককালের মানব জাতির দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। সমস্ত বিষয়গুলোকে সে রকম নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করার দায়িত্ব গুণী পাঠকদের।
ইসলামকে ধর্ম হিসাবে দেখলে তা শুধু মুসলিমদের ধর্মে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে ইসলামকে যদি একটি সর্বজনীন বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে দেখা যায় তাহলে তা পৃথিবীর সমগ্র মানব জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য কল্যাণকর একটি ধারণা বা ধর্মে পরিণত হয়। এ দুটি ধারণার মধ্যে কোনটা যুক্তিসঙ্গত এবং আল্লাহতালার কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য এই সমস্যার নিষ্পত্তি আল্লাহতালা কর্তৃক নবীকে (সঃ) উদ্দেশ করে বলা সুরা সা-বা’র ২৮ নম্বর আয়াত: “আমি তো তোমাকে সমগ্র মানব জাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা উপলব্ধি করে না”-এর আলোকে করলেই বুঝা যায় আল্লাহতালা নবী’র (সঃ) কাছে ধর্ম পাঠাননি বরং মানব জাতির সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি পাঠিয়েছেন। এ জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, ইসলাম কোনো ধর্ম নয় বরং সর্বকালের মানুষের জন্য আল্লাহতালার তরফ থেকে দেওয়া “একটি সর্বজনীন বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি”।
সকল মানব শিশুরই জন্ম হয় এক আলাক স্তরে। এটাই সকল মানুষের আদিরূপ বা মূলরূপ। সেখান থেকে যুগে যুগে জগত সংসারে নির্ধারিত বিশেষ বিশেষ কর্ম সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে এক একজন মানব শিশুকে গড়ে তোলা হয় এক একজন পৃথক ইনছান মানুষ হিসাবে। শিশু বয়স থেকে ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের উপাত্তসমূহকে স্মৃতি হিসাবে মস্তিষ্কে সংরক্ষণের মাধ্যমে মানব বুদ্ধির ভাণ্ডার গড়ে তোলা এবং পরবর্তীতে চিন্তন প্রক্রিয়ার সাহায্যে স্মৃতিগুলোকে তুলে এনে জীবনে বাস্তব পরিস্থিতির মোকাবেলা করা ইত্যাদি সবগুলো প্রক্রিয়ার পেছনে থাকে একজন সৃষ্টিকর্তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা। এভাবেই গড়ে ওঠে মানুষের অভ্যাস। আর এই অভ্যাসের দাস হিসাবে মানুষ জীবনে সবকিছু পালন করে থাকে। জাতি, ধর্ম-বর্ণ, স্থান-কাল নির্বিশেষে সকল মানব শিশুর জন্য এটা এক চিরন্তন নিয়ম। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে পৃথিবীর সকল মানুষই একজন অমৃতের সন্তান। মানুষের এই প্রকৃত পরিচয়ের পরও প্রতিটি মানুষ পৃথিবীতে আলাদা আলাদা পরিচয়ে জীবনযাপন করে ও আলাদা আলাদা ভাবে মৃত্যুবরণ করে। মানব জীবনের এই সমস্ত কিছুর নিয়ন্তা যিনি তিনিই সৃষ্টিকর্তা। সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মা ও জগত-সংসার পরিচালিত হয় নির্দিষ্ট বিধি মোতাবেক বা সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট অমোঘ নিয়মে। সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসাবে মানুষ পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধিত্ব করে। সেই সাথে পৃথিবীতে চলার জন্য মানুষের স্বাধীনতাও রয়েছে। সৃষ্টিকর্তার বিধি মোতাবেক পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করা এবং নিজের ইচ্ছামতো স্বাধীনভাবে চলা এই দুইয়ের সংঘাতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়। সেজন্য যুগে যুগে কিতাবসহ নবী-রসুল পাঠানো হয়েছে মানুষকে দিক নির্দেশনা দিতে অর্থাৎ মানুষকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি দিতে। এই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিটির নামই ইসলাম বা সর্বজনীন একটি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি, যা প্রচার করার জন্য আল-কোরআনের মাধ্যমে শেষ নবী মুহম্মদ (সঃ) ও সকল নবী-রাসূলকেই আল্লাহতালা আদেশ দিয়েছেন। কোরআনের আলোকে এই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে এই গ্রন্থে।
এসআইএইচ