সিরাজগঞ্জে বাগবাটির গণহত্যা নিয়ে "হননকালের প্রত্নপুরান"
একরাশ হতাশা আর চোখমুখে আতঙ্ক নিয়ে খেটে খাওয়া মানুষ জড়াজড়ি করে বসেছিলেন বিদ্যালয়ের কক্ষে। বিপরীত প্রান্ত থেকে বুটের খট-খট আওয়াজ ভেসে আসছিল। বুটের আওয়াজ তীব্রতর হতেই নিঃশব্দে সংকুচিত হচ্ছিলেন আতঙ্কিত মানুষ। হঠাৎ ভয়ংকর অট্টহাসিতে একদল পাকসেনা ঢুকে পড়ে। সঙ্গে তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরেরা। বেয়নেট, চা-পাতি, কোদাল, তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র মানুষের উপর। নরপিশাচগুলোর অট্টহাসির মাঝে মিলিয়ে যায় সাধারণ মানুষের মরণ চিৎকার।
শুক্রবার (২৯ জুলাই) রাতে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বাগবাটি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রদর্শিত "হননকালের প্রত্নপুরান" নাটকে শুরুটা ছিল এমনই। নাটকের প্রতিটি দৃশ্য এতটাই শ্বাসরুদ্ধকর ছিল যে কয়েক হাজার দর্শক নিরব নিস্তব্ধ হয়ে উপভোগ করেছে ঐতিহাসিক এ নাটক।
নাটকটির মাধ্যমে ১৯৭১ সালে নিরীহ বাঙালির উপর পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের লোমহর্ষক চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন সিরাজগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির অভিনেতারা।
নাটক শেষ হবার পর অনেককেই চোখ মুছতে দেখা যায়। বৃদ্ধ, প্রৌঢ় থেকে শুরু করে শিশু-কিশোরদের চোখও ছলছল করছিল। এ তাদেরই পুর্বসূরীদের গল্প। নাটক শেষে কথা হয় বিভিন্ন শ্রেণির দর্শকদের সঙ্গে। সবাই বলছিলেন, এমন হৃদয় বিদারক নাটক আগে দেখিনি।
দত্তবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ও বাগবাটি ডিগ্রি কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র ফিরোজ আহমেদ বলছিলেন, বাপ-দাদার কাছে বাগবাটি গণহত্যার গল্প যেমনটা শুনেছি, এখানে যেন তেমনটাই দেখলাম। তার কথায় সায় দেন সহপাঠী আহমেদ শাকিল ও রাসেল। এ তিন কলেজছাত্র আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছেন। তাদের ভাষ্য জীবনে এত সুন্দর নাটক দেখিনি।
বাগবাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী চক মিরাখোর গ্রামের জিহাদ ও ইদ্রিস হোসেনসহ অনেক শিক্ষার্থী বলে নাটকটি অসাধারণ লেগেছে। এখানে বদ্ধভূমির কথা দাদাদের কাছে শুনেছেন। আজ নাটকের মাধ্যমে দেখলেন।
কয়েক কিলোমিটার দূর সীমান্ত বাজার থেকে এসেছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী নিজাম উদ্দিন। অশ্রুসজল নয়নে তিনি বলছিলেন, সত্যি আমার কান্না পেয়েছে। কতটা নির্মম ছিল পাক বাহিনী ও রাজাকারেরা। এ নাটকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
জাহানারা খাতুন নামে ষাটোর্ধ নারী বলেন, ‘বাবাগো আমি তহন ১০ বছরের আচিলাম। তহন বাপ-মায়ের মুহের দিকে চাওয়া যাই নাই। খালি ভয়ে ভয়ে থাইকতো। বড়গোরে দেইহ্যা আমাগোরে মুহেও কতা আচিল না। এই নাটকে হেইসব দৃশ্য দেইহ্যা চোহে পানি আইস্যা গেছে।’
বাগবাটি গ্রামের তাঁত শ্রমিক রবিউল ইসলাম, আল-আমিন, অটোরিশা টালক আব্দুর রাজ্জাকসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষের মুখে যেন একই কথা, বাপ-দাদাদের মুখে শোনা ঘটনাই নাটকের মধ্যে দেখানো হয়েছে।
গ্রাম পুলিশ সুবোধ চন্দ্র দাস বলেন, যুদ্ধের সময় আমার বয়স ১৫/১৬ বছর। আমি অনেক কিছুই দেখেছি। আজকের নাটকের মাধ্যমে সেই চিত্রটা আবারও দেখলাম।
শহর থেকে নাটক দেখতে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা কোরবান আলী বিন্দু ও আব্দুল মালেক বলেন, এ যেন বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। যতক্ষণ নাটক দেখেছি মনে হয়েছে আমরা যেন একাত্তরেই রয়েছি।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৭ মে বাগবাটি এলাকায় ঢোকে পাক হানাদার বাহিনী। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় এ অঞ্চলের ২ শতাধিক হিন্দু-মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা। গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, কোদালে কুপিয়ে, গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে এবং জবাই করে এসব মানুষকে হত্যা করা হয়। সেদিনের সেই চিত্রটি ফুটিয়ে তুলতেই পরিবেশ থিয়েটার মঞ্চায়ন করে। যেখানে গণহত্যা হয়েছে সেই স্কুলটিকেই স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
জেলা শিল্পকলা একাডেমি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পৃষ্ঠপোষকতায় গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটারের আওতায় নাটকটি রচনা করেছেন মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা ও নির্দেশনায় ছিলেন জেলা কালচারাল অফিসার মাহমুদুল হাসান লালন। নাটকটির চরিত্রায়নে ছিলেন জেলা শিল্পকলা একাডেমির ৫০ জন অভিনেতা-অভিনেত্রী। কুশীলবে ছিলেন আরও ৩০ জন। প্রায় ৩ হাজার দর্শক নাটকটি উপভোগ করেছে।
নাটকটির নির্দেশক ও জেলা কালচারাল অফিসার মাহমুদুল হাসান লালন বলেন, পরিবেশ থিয়েটারের অর্থ হলো, ঘটনাটি যেখানে ঘটেছিল, ঠিক সেখানে সেই আবহ সৃষ্টি করেই নাটক মঞ্চায়ন। ১৯৭১ সালের ২৭ মে বাগবাটির গণহত্যার ঘটনাটি ছিল সিরাজগঞ্জের সবচেয়ে লোমহর্ষক ঘটনা। এ ঘটনাটি নিয়েই ছিল নাটক। শিল্পকলা একাডেমির ৫০ জন পারফরমার টানা দুই মাস রিহার্সেল করে নাটকটি প্রস্তুত করা হয়েছে। যে স্কুলটিতে গণহত্যা হয়েছিল, তার পুরো মাঠটিকেই মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। নাটক মঞ্চায়নের আগে ওই গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী এবং বেঁচে যাওয়া সাক্ষীদের সঙ্গেও অভিনেতারা কথা বলেছেন।
নাটকটির লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম বলেন, নাটকটি দেখতে কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে মানুষ মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে প্রত্যেকের চোখ ছলছল করে। কিন্তু আমরা যারা গল্প বলি সেটা আমাদের নিজের গল্প যা জনগণের সঙ্গে মেলে না। যার ফলে মনে হয় জনগণ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হয়ে যাচ্ছে। গল্প হতে হবে জনগণের গল্প, তাদের কাছের গল্প। যাতে খুব সহজেই মানুষ গ্রহণ করবে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তারা মাঠে নামবে।
এসএন