শনিবার দশম সঞ্জীব উৎসব
হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে হাওরের কূল ঘেঁষে ছোট্ট একটি গ্রাম মাকালকান্দি। সবুজ প্রকৃতিঘেরা সেই গ্রামীণ পরিবেশে ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর জন্ম নেয় একটি শিশু। তার নাম রাখা হয় সঞ্জীব, মানে সঞ্জীব চৌধুরী। যিনি পরবর্তীকালে একাধারে দেশের বিশিষ্ট গীতিকার, গায়ক, সাংবাদিক ও সংগঠক হয়ে ওঠেন। নিজের সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা দিয়ে একসময় পরিচিত মহলে তার পরিচয় হয়ে ওঠে সবার প্রিয় সঞ্জীবদা হিসেবে। শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) প্রয়াত সংগীতশিল্পী সঞ্জীব চৌধুরীর জন্মদিন। এ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘দশম সঞ্জীব উৎসব ২০২১’।
জন্মদিনে সঞ্জীব উৎসব অনুষ্ঠিত হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অবস্থিত সঞ্জীব চত্বরে। ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'সঞ্জীব উৎসব উদ্যাপন পর্ষদ' আয়োজন করছে এ উৎসব। দশমবারের মতো আয়োজিত এ উৎসবে গান করবেন শুভযাত্রা, জয় শাহরিয়ার, সাবকনশাস, বে অব বেঙ্গল, সাহস মোস্তাফিজ , লালন মাহমুদ, সুহৃদ স্বাগত, দুর্গ, ইন্ট্রোয়েট ও ব্যান্ড বিস্কুট।
এবারের উৎসবে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে সঞ্জীব চৌধুরীর গান কবিতা সমগ্র 'তোমাকেই বলে দেব'। জয় শাহরিয়ারের সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিতব্য বইটিতে সঞ্জীব চৌধুরীর প্রকাশিত সব লিরিক স্থান পেয়েছে এক মলাটে। বইটি প্রকাশ করছে আজব প্রকাশ।
সঞ্জীব উৎসবের অন্যতম আয়োজক সংগীতশিল্পী জয় শাহরিয়ার বলেন, দেখতে দেখতে ১৪ বছর হয়ে গেল সঞ্জীবদা নেই। উৎসবেরও দশ বছর পেরিয়ে গেল। সঞ্জীব উৎসব দাদাকে ভালোবেসেই করা। এ উৎসবের মূল উদ্দেশ্য যারা দাদাকে কাছে পায়নি, তাদের কাছে দাদার গান ও গানের দর্শন পৌঁছে দেওয়া।
এ আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতা করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যান্ড সোসাইটি এবং আজব কারখানা। বিকেল ৪টায় শুরু হবে এই আয়োজন।
সঞ্জীব চৌধুরীর বাবা স্বর্গীয় ননী গোপাল চৌধুরী এবং মা প্রভাষিণী চৌধুরী। পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে সঞ্জীব ছিলেন সপ্তম। তার স্ত্রী প্রজ্ঞা নাসরীন ও একমাত্র মেয়ে কিংবদন্তি। শরীরে জমিদার বংশের রক্ত থাকার পরও সঞ্জীব একজন সাধারণ মানুষের মতোই নিজের কর্ম ও সাধনায় নিজেকে বিলিয়েছিলেন। অসম্ভব প্রাণচঞ্চল ও উদ্যমী মানুষ ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত থাকলেও গানের জগতে আত্মপ্রকাশের আগ পর্যন্ত তার নাম-পরিচয় তেমন একটা প্রচার পায়নি। আত্মপ্রচারবিমুখ মানুষটি বেশির ভাগ সময়ই সভা-সমাবেশ এড়িয়ে চলেছেন। তবে ঘরোয়া আড্ডায় তিনি ছিলেন সবার মধ্যমণি। আর সে আড্ডায় অপরিহার্য ছিল তার গান। কখনো কখনো পত্রিকার অফিসকক্ষেই টেবিলে তবলার বোল ফুটিয়ে একের পর এক গান গেয়ে যেতেন। গানই ছিল সঞ্জীব চৌধুরীর প্রাণ।
আশির দশকেই অডিও বাজারে আসন গেড়ে বসতে পারতেন সঞ্জীব চৌধুরী। কিন্তু তিনি তা চাননি। সংশয়, নির্লিপ্ততা আর আলসেমি হয়তো এর মূল কারণ ছিল। প্রিয়জনের অনেক ঠেলাধাক্কার পর নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে কণ্ঠশিল্পী বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে মিলে বের করেন তার প্রথম অ্যালবাম 'আহ্...'। দুজনে মিলে গঠন করেন ব্যান্ড 'দলছুট'। তার প্রথম অ্যালবাম প্রকাশের পরই সংগীতবোদ্ধা ও শ্রোতামহলে বেশ সাড়া পড়ে যায়। এরপর দলছুট থেকে একে একে বের হয়েছে 'হৃদয়পুর', 'স্বপ্নবাজি', 'আকাশচুড়ি', 'জোছনা বিহার' অ্যালবাম। এর মধ্যে 'স্বপ্নবাজি' সঞ্জীবের একক অ্যালবাম। সঞ্জীব চৌধুরীর গাওয়া গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'গাড়ি চলে না চলে না রে', 'তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ', 'সাদা ময়লা রঙিলা পালে', 'আমি তোমাকেই বলে দেব', 'আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ', 'তোমার ভাঁজ খোলো আনন্দ দেখাও', 'এক পলকেই চলে গেল', 'চোখটা এত পোড়ায় কেন', 'আগুনের কথা বন্ধুকে বলি', 'হাওয়ারে তোর পায়ের ঘুঙুর', 'আমার বয়স হলো সাতাশ' ইত্যাদি।
সংগীতশিল্পীর পাশাপাশি সঞ্জীব চৌধুরী কবি পরিচয়েও উজ্জ্বল। তার গানের মধ্যেও কবিতার আবেশ পাওয়া যায়। লিখেছেন ছোটগল্পও। আর পত্রিকায় লিখেছেন অসংখ্য ফিচার। শুধু নিজেই ফিচার লেখেননি, অনেককে দিয়ে ফিচার লিখিয়েছেন এবং শিখিয়েছেন। সঞ্জীব চৌধুরীর কাছে হাতেখড়ি নেওয়া অনেক গুণী সাংবাদিক বর্তমানে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে আছেন। সঞ্জীব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তার হাত ধরেই একসময় দেশের দৈনিক পত্রিকার ফিচার পাতা নতুন রূপ-রঙ ধারণ করেছিল। ২০০৭ সালের ১৮ নভেম্বর সবাইকে ছেড়ে অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমান তিনি।