বইপ্রীতি গড়ে তুলি, বই পাঠের অভ্যাস করি
বিশ্ব বইদিবস কিংবা কপইরাইট দিবস, ইউনেস্কো ঘোষিত একটি বাৎসরিক অনুষ্ঠান। যেটি বছরে একবারই হয় এবং সারা পৃথিবী জুড়েই এটি হয়। ইউনেস্কোর সাথে সংযুক্ত সারা পৃথিবীর সদস্য রাষ্ট্রগুলি দিবসটি একসাথে পালন করে থাকে। এটি কখন থেকে পালন করা হচ্ছে, আমি মনে করি সেটিও জানার দরকার আছে। বই এবং কপিরাইট দুটি অত্যন্ত সংযুক্ত বিষয়। প্রথমত আমাদের জানা প্রয়োজন বই কি? এবং বই কিভাবে তৈরি হয়?
বই হচ্ছে একজন মানুষ যা চিন্তা করে এবং চিন্তা করার পর সে সেটিকে ধারণ করে রাখতে চায়। সেটি ছাপা অক্ষরে মুদ্রিত করে অথবা অন্যকোনভাবে ধারণ করে রাখতে চায়। অর্থাৎ একজন লেখকের ভিতরের যে চিন্তাশীলতা অথবা সৃষ্টিশীলতা, তারই ধারণকৃত একটি রূপ হলো বই। বই বলতে আমরা মূলত যেটিকে বুঝি, তাহলো কাগজে মুদ্রিত আকারে ধারণকৃত মানুষের চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। একসময় গুহাগাত্রে মানুষ যখন লিখতে শুরু করেছিল, অথবা পাতায় কিংবা চামড়ায়, সেটিই মুদ্রণ ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পরে প্রচ্ছদ আকারে, বাঁধাই করা অবস্থায় অর্থাৎ বই আকারে আমরা পাচ্ছি। তবে এখন পর্যন্ত বই বলতে আমরা মূলত মুদ্রিত অবস্থাটিকেই বুঝি। এই বইয়ের ভিতর যা কিছু লিখিত হয়, সমস্ত মালিকানা যিনি লিখেছেন, তাঁর। একজন প্রকাশক সেটি প্রকাশ করার সার্বিক দায়িত্বটুকু পালন করে থাকেন এবং পাঠকের দৌড় গোঁড়ায় পৌঁছে দেন। পাঠক তা পাঠ করে নিজেদের ঋদ্ধ করেন। ফলে লেখক, প্রকাশক, পাঠক এই তিনটিকে সমন্বয় করেই ইউনেস্কো বইয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে দিনটি উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং করতে শুরু করে। আমরা যতদূর জানি, এই দিনটি শুরু হয়েছিল স্পেনে একজন বিখ্যাত লেখকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সূচক এবং পরবর্তীতে স্পেনের পাশাপাশি জার্মানি, ইউরোপের দেশ সমূহসহ মার্কিন যুক্ত্ররাস্ট্র একে একে প্রায় সব দেশেই রেওয়াজটি চালু হয়ে যায়। এখন সেটি বিশ্বব্যপি ছড়িয়ে পড়েছে।
১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো একটি ভিন্নধর্মী সিদ্ধান্ত নেয়। সেটি হলো, বই এবং কপিরাইট দিবস সারা পৃথিবীতে একদিনে পালিত হবে এবং সেই দিনটি হচ্ছে ২৩ এপ্রিল। ২৩ এপ্রিল অনেক কারণেই বিশেষ করে অনেক বিখ্যাত লেখকদের জন্ম এবং মৃত্যু দিবস হওয়াতে স্মরণীয়। এঁদের মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত লেখক ও নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের মৃত্যু দিবস এ দিন। দিবসটি পালন করার আরও একটি কারণ হলো, বই যখন গুহাচিত্র থেকে, তালপাতার পুঁথি থেকে, চামড়ায় লেখা এবং কাগজে মুদ্রিত হবার পাশাপাশি ইলেকট্রনিক মিডিয়া অর্থাৎ ই-বুকের দিকে চলে গেল, তখন প্রশ্ন উঠল, মানুষ আর কাগজে মুদ্রিত বই পড়বে কিনা। এতে মানুষের ভিতর পাঠাভ্যাস পদ্ধতি পরিবর্তন হবে কিনা। কাজেই বই পড়ার প্রবণতা জিইয়ে রাখার জন্য, পাঠাভ্যাস বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য এবং বইপাঠের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যই ইউনেস্কো এই উদ্যোগ নেয় এবং এখনও তা চলছে।
ধর্মগ্রন্থ পাঠের সময় মানুষের ভিতর যে পবিত্রতা শুরু হয়, বইপাঠ করার সময়ও সেই পবিত্রতা শুরু হয়ে যায়। আমাদের বই পড়ার অভ্যাসটুকু গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের হাতে বই তুলে দিতে হবে। শিশুরা বই খুব ভালোবাসে। শিশুদের কল্পনা শক্তিকে বাড়াতে একটি বই লিখার সাথে সাথে ছবিও সাথে এঁকে দেওয়া হচ্ছে। যেমন-উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হেমিলনের গল্পের সাথে সাথে হেমিলনের বাঁশিওয়ালার ছবিটিও যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। যেন শিশুরা পড়ার পাশাপাশি ছবি দেখে ভাবতে পারে। শিশুদের সুকুমারবৃত্তির বিকাশ ঘটাতে বই অনস্বীকার্য একটি উপাদান।
বড়দের জন্য বই হলো যাপিত জীবনের অন্যতম এক অনুষঙ্গ। বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়াম বলেছিলেন, রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কাজল চোখ ঘোলা হয়ে যাবে, তখনও অনন্ত যৌবনা হয়ে পাশে রয়ে যাবে একটি ভাল বই। বই কখনও ফুরাবে না। বই কখনও ফুরিয়ে যায় না। মানুষ যেমন খোলা আকাশের নিচে বাস করে না, সে একটি সুন্দর বাড়ি বানায়, সাজিয়ে রাখে, ঠিক তেমনি মানুষের ভিতরের সুন্দরটুকু ধরে রাখার জন্য, তার ভেতরের নিরাকার জ্ঞানকে ধরে রাখার জন্য অন্যতম মাধ্যম হলো বই। পবিত্র কোরআন শরীফে একটি কথা আছে, “ইকরা” অর্থাৎ পাঠ কর। আমরা যেমন প্রকৃতিকে পাঠ করি, আমরা আমাদের মনকে পাঠ করি এবং ঠিক তেমনি আমাদের বইয়ের ভিতর লিখিত যে জ্ঞান সেটিকে আমরা পাঠ করি । বইয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, বই আমি আমার বুকে ধরে, আগলে রেখে, আমার কাছে রাখতে পারি। আসুন, আমরা বিশ্ব বইদিবসে আত্মপ্রত্যয়ী হই, বইপ্রীতি গড়ে তুলি, বই পাঠের অভ্যাস গড়ে তুলি। নিজেদের জীবনকে আরও বেশি সুন্দর, ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলি। সকলে বইদিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক: বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক