বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন মানুষে মানুষে মানবিক সদাচার
নববর্ষ আমাদের জীবনের অন্যতম জাতীয় উৎসব। এবারের উৎসবটি একটু ব্যতিক্রম এবং বিশেষ গুরুত্বপুর্ণ। কোভিড পরবর্তি সময়ে এবারের উৎসব হচ্ছে। তাই সবার উদ্দীপনাও অপেক্ষাকৃত বেশি। এর আগেও অতিমারি মহামারি যেভাবেই বলি না কেন, পৃথিবীতে বহুবার এসেছে। সবকিছুর আয়ু যেমন একসময় ফুরায়, অতিমারি মহামারিও একসময় ফুরিয়ে যায়। তারপর পুনরায় জীবনের স্বাভাবিক যে চলমানতা সেটি শুরু হয়। প্রকৃতির সাথে যুক্ত পাখি, মাছ, প্রকৃতির শস্য সবকিছুই আবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিকশিত হয়। একসময় মানুষের প্রাণের যে যাত্রা সেটি ব্যহত হয়েছিল। কোভিড প্রাণকে আঘাত করেছিল, মৃতুকে ত্বরান্বিত করেছিল, মানুষ নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল এবং সাবধানতা অবলম্বন করেছিল। দুই বছরের বেশি সময় পরে, সবকিছুকে মেনে ও মানিয়ে নিয়েই, মুখোশকে পরিত্যাগ না করে, বরং সাবধানতা অবলম্বন করেই মানুষ আবার বেরিয়ে আসার সুযোগ পেয়েছে। প্রাণের উচ্ছ্বাস, জীবনের উচ্ছ্বাস, প্রকৃতির উচ্ছ্বাসের মত আবার জেগে উঠেছে মানুষ।
আমাদের দেশ অসাম্প্রদায়িকতো বটেই। আমাদের সংবিধানেই সকল ধর্মের সমন্বয় করা আছে। ধর্ম মানেই ধারণ করা। দেখা যায়, সব ধর্মের সূত্র কিন্তু এক। প্রকৃতপক্ষে ধর্মে কোনো বিভেদ নাই। ধর্মে ধর্মে যে বিদ্বেষ এটি খুবই পীড়াদায়ক। এটির কারণ ধর্মের প্রকাশভঙ্গি। এক এক ধর্মের প্রক্রিয়া, উপাসনা পদ্ধতি, শোভা এক এক রকম । কিন্তু সকলই কল্যাণকর। কাজেই ধর্মকে কলুষিত করে যারা সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করতে চায়, তারা আসলে ধর্মের শত্রু। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান চেয়েছিলেন, মানুষে মানুষে মানবিক সদাচার। মানবিক সদাচার থাকলে আজকে আমরা যে সাম্প্রদায়িকতার কথা বলছি, সেটিতো আসতেই পারে না। এমনকি সর্ব ধর্মের মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়টি সেটিকে সোনার পাথর বাটির মতই মনে হয়। বাংলাদেশ আমরা সব ধর্মের মানুষকে ধারণ করে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকল ধর্মের মধ্যে রঙ নিয়ে আসার কথাই বলেছিলেন। এজন্য আমরা বলি সংস্কৃতিকে আরও উন্নত করতে হবে। বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে সব ধর্মের যে সারাৎসার উৎসবের ভিতর মানুষকে সুস্থ করার যে প্রক্রিয়া সেটি যথাযথভাবে পালন করা উচিত।
আমি আমার জীবনের শুরুতে যে মাটির সংস্কৃতি দেখেছি সেটি সুন্দর ছিল। আমাদের বাড়ির পাশে মেলা হত। হোলি খেলা হত। চৈত্রসংক্রান্তির পরে এসবই আমরা দেখে বড় হয়েছি। তারপর ঈদ পূজা পার্বণের উৎসব দেখেছি। আমার এলাকা রামুতে বৌদ্ধদের উৎসব এবং ওই এলাকায় চীন সম্প্রদায়ের বসবাস আছে। ছোটবেলা থেকেই সব সম্প্রদায়ের সব ধরণের কালচারের সাথে আমাদের পরিচয় এবং বসবাস। অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির মধ্যে আমার বেড়ে উঠা। তারপর ৬৫ সালে যখন ঢাকায় এলাম, তখন বাঙ্গালি সংস্কৃতির সাথে আরও ব্যাপকভাবে পরিচয়। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ করতে গিয়ে বাঙ্গালির তিন হাজার বছরের যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সেখান থেকে এক জাতিতে পরিণত হবার যুক্তি গ্রহণ করেছিলেন। আমাদের ভাষা এক, কাজেই সেই ভাষার যুক্তিকে গ্রহণ করেছিলেন। তারপর আমরা যে অখণ্ড দেশের অধিকারি হতে পারি, প্রত্যেক মানুষ আমাদের সার্বভৌমত্ব চায়, এই তিনটি যুদ্ধ তিনি সম্পন্ন করেছিলেন।
নববর্ষে ছায়ানটের বর্ষবরণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হালখাতা, মিষ্টি বিতরণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, বাঙালি সংস্কৃতির যে মূল অবদান, এভাবেই প্রবাহিত হয়। বর্ষবরণের অনুষ্ঠান এখন ঢাকা শহরের পাশাপাশি দেশের সর্বত্র হয়। দিনে দিনে এর ব্যপ্তি বাড়ছে।
পয়লা বৈশাখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান চেয়েছিলেন, মানুষে মানুষে মানবিক সদাচার। মানবিক সদাচার থাকলে আজকে আমরা যে সাম্প্রদায়িকতার কথা বলছি, সেটিতো আসতেই পারে না। এমনকি সর্ব ধর্মের মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়টি সেটিকে সোনার পাথর বাটির মতই মনে হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে শুরু হয়। আশা করছি এবারও শোভাযাত্রা হবে নির্ভেজাল ভাবেই। সকলের জন্য এই শোভাযাত্রাকে কল্যাণকর মনে করা হয়। আসল কথা হচ্ছে, নববর্ষের শিক্ষা থেকে বাঙ্গালির মূর্ত এবং বিমূর্ত সকল প্রকার সংস্কৃতির ভালটুকু আমাদের গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা শহরের মাঠে এবং গ্রাম বাংলার পথে পথে এই মঙ্গলশোভা যাত্রা উদজীবিত রাখতে হবে। সুন্দরকে ধারণ করে, সুন্দরের শিক্ষা নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক: মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি।