নববর্ষের সূর্য
বাংলা নববর্ষ বাঙালির জীবনে শুধু একটি মাত্র দিন নয়।
একটি মাত্র উৎসবও নয়।
এই দিনকে কেন্দ্র করে উচ্চারিত হয়েছে বহুমাত্রিক অর্থ। জীবনের গভীর অর্থ খোঁজার যে মৌল দর্শন একটি জাতির চিন্তা-চেতনায় বিরাজ করে সেই অর্থের সবটুকু ধারণ করে আছে বাংলা নববর্ষ দিন।
এই উৎসব বাঙালি জাতীয়তাবাদের মৌল অনুপ্রেরণা। অসাম্প্রদায়িক বাঙালির আকর আধার। মনুষ্যত্ব বিকাশের শুভ শক্তি। আত্মপরিচয় বৃদ্ধির মূল ক্ষেত্র। বিশ্বজোড়া মেলবন্ধনে মানবিকতার মৌলিক শর্ত।
বাংলা নববর্ষের উৎসব আছে বলে বাঙালির পরাজয় নেই। জাগরণের ঘণ্টাধ্বনি বাজায় এই উৎসব। মানুষ জড়ো হয় আপন নিয়মে। এই উৎসব শহরের ইটকাঠ থেকে গ্রামের মেঠোপথ পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্য অর্থে বলা যায়, এই উৎসব বয়ে এনেছে শস্যদানা। জলবতী মেঘ। রূপালি ইলিশ। বিনয় বাঁশির ঢোল। এখন এর সবটুকু শহরের প্রতিটি মানুষের প্রাণের স্পন্দন। নন্দিত হয় পুরো দেশ।
মনীষী অন্নাদাশঙ্কর রায় তাঁর ‘সংস্কৃতির বিবর্তন’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, “আমরা ক্রমশ হৃদয়ঙ্গম করছি যে দেশকে স্বাধীন করাই যথেষ্ট নয়। দেশের মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে, সৃষ্টি করতে, নির্মাণ করতে শেখাতে হবে। পশ্চিমের সঙ্গে, আধুনিকের সঙ্গে পা মিলিয়ে নিতে হবে। পশ্চাতের সঙ্গে, ঐতিহ্যের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করতে হবে। জনগণের সঙ্গে লোক সংস্কৃতির সঙ্গে যোগসূত্র অবিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। সার্থক সংস্কৃতির এই তিনটি ডাইমেনশন।”
বাংলা নববর্ষে সংস্কৃতির এই তিনটি ডাইমেনশনকে বাঙালির মর্মমূলে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। বাঙালি বুঝতে পেরেছে এই গোড়াটুকু আছে বলেই কোনো অপশক্তি তাদেরকে উপড়ে ফেলতে পারেনি। পাকিস্তান আমলের পুরো সময় ধরে এই চেষ্টা করেছে পাকিস্তানি সরকার। এই শক্ত বাঁধনটুকু ছিল বলেই দন্ত-নখর বিস্তৃত করেও কিছুই করতে পারেনি তারা। বরং বাঙালি আত্মশক্তি সঞ্চয় করেছে আরও প্রবলভাবে।
ঢোল বাঙালির প্রাচীনতম লোকবাদ্য-যন্ত্র। উৎসবে বেজেছে- আনন্দের ধ্বনি হয়ে দিকবিদিক ছড়িয়েছে। প্রয়োজনে বেজেছে- ঢোল পিটিয়ে মানুষকে জড়ো করা হয়েছে- মানুষের কাছে খবর পৌঁছানোর জন্য সংকেত দেওয়া হয়েছে। প্রাচীনকালে হাট-বাজারে ঢোলের বাড়ি পড়লে মানুষ দৌড়ে আসত, বুঝে নিত যে তাদের জন্য কোনো জরুরি বার্তা আছে।
বাংলা নববর্ষ মানুষকে সেই বার্তা দেয় যখন রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে মৌলবাদী জঙ্গীরা বোমা ফাটায়। যখন যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে কিংবা নেত্রকোনার অনুষ্ঠানে বোমা ফাটে। অশুভ শক্তির বার্তায় মানুষ পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে আর একটি নববর্ষ উৎসব উদযাপন করে।
বাঙালির পথচলায় নববর্ষ বাতিঘর। বিভ্রান্তির যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই বাঙালির। অমোঘ শক্তির দীপ্তি তার মাথার উপর ছায়া হয়ে আছে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধে বলেছেন, “এই মহামান্বিত জগতের অদ্যকার নববর্ষদিন আমাদের জীবনের মধ্যে যে গৌরব বহন করিয়া আনিল, এই পৃথিবীতে বাস করিবার গৌরব, আলোকে বিচরণ করিবার গৌরব, এই আকাশতলে আসীন হইবার গৌরব, তাহা যদি পরিপূর্ণভাবে চিত্তের মধ্যে গ্রহণ করি তবে আর বিষাদ নাই, নৈরাশ্য নাই, ভয় নাই, মৃত্যু নাই।”
বাঙালি এই গৌরবের জায়গাটি তৈরি করেছে। মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দান করে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলা ভাষার স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করে উপমহাদেশের মানচিত্র বদলে দিয়েছে। তারপরও বলতে হবে দুটো গভীর ও ব্যাপক অর্জন বাঙালির সামনে পাহাড় সমান উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক. যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং দণ্ড প্রদান। দুই. হতদরিদ্র মানুষের জীবন থেকে দারিদ্র্যের অবসান ঘটিয়ে তাদেরকে মানসম্মত জীবনযাপনের ব্যবস্থা প্রদান।
নইলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে নববর্ষকে মূলে রেখে যে আনন্দের কথা বলেছেন তা প্রকাশের যথার্থতা এই দেশে থাকবে না, যারা বাংলা নববর্ষের উত্তরাধিকারী।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে একটি ঋষিবাক্য উল্লেখ করে বলেছেন ‘কেই বা শরীরচেষ্টা করিত, কেই বা প্রাণধারণ করিত যদি এই আকাশে আনন্দ না থাকিতেন।
আকাশ পরিপূর্ণ করিয়া তিনি আনন্দিত, তাই আমার হৃৎপিন্ড স্পন্দিত, আমার রক্ত প্রবাহিত, আমার চেতনা তরঙ্গিত। তিনি আনন্দিত, তাই সূর্যলোকের বিরাট যজ্ঞহোমে অগ্নি-উৎস উৎসারিত; তিনি আনন্দিত, তাই পৃথিবীর সর্বাঙ্গ পরিবেষ্টন করিয়া তৃণদল সমীরণে কম্পিত হইতেছে; তিনি আনন্দিত, তাই গ্রহে নক্ষত্রে আলোকের অনন্ত উৎসব। আমার মধ্যে তিনি আনন্দিত, তাই আমি আছি- তাই আমি গ্রহতারকার সহিত লোকলোকান্তরের সহিত অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত- তাহার আনন্দে আমি অমর, সমস্ত বিশ্বের সহিত আমার সমান মর্যাদা।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি অসাধারণ বাক্য সংযোজন করেছেন- ‘সমস্ত বিশ্বের সহিত আমার সমান মর্যাদা।’ বাঙালির সামনে আজ এই চ্যালেঞ্জ। বাংলা নববর্ষকে সামনে রেখে বাঙালিকে এই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
লেখক: বাংলা একাডেমির সভাপতি ও সাহত্যিকি