পাখিদের বন্ধু, অভিযানের সূচনাকারী
ইনাম আল হক আরো একটি পুরস্কারে ভূষিত হলেন। এবারের বাংলা একাডেমিতে তাকে বিজ্ঞান সাহিত্যের পদকটি দেওয়া হয়েছে। নির্লোভ, একাকী, নিভৃতাচারী ইনাম আল হকের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের বহু বছরের পরিচয়। তিনি আমাদের পাখি দেখা কার্যক্রমের প্রাণপুরুষ। এই দেশে পাখি দেখা ও পাখিদের ভালোবাসার বোধটি গড়ে দিয়েছেন বিমান বাহিনীর সাবেক এই উধ্বর্তন কমকতা। এরপর তিনি পাখিমেলার শুরু করেছেন। প্রথমটি হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরে তিনি ও তার বন্ধু-সহযাত্রীরা সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন এই পাখিমেলার আয়োজন।
যখন এই পাখিমেলার শুরু হলো কেউ ভাবতেও পারেননি মেলা এমন হয়। তবে ইনাম আল হক সবসময়ই সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ কামনা করেন, সেভাবেই নিজের জীবনকে পরিচালিত করেছেন। তারা পাখির আলোকচিত্র প্রদর্শনী করেছেন, সেগুলোকে দেখার জন্য টেলিস্কোপ নিয়ে এসেছেন সাধারণ মানুষ ও শিশুদের কাছে। সেসব জায়গায় পাখির বইয়ের প্রদর্শনী ও বিক্রি হয়েছে। পাখি নিয়ে আলোচনা সভা করেন তারা নিয়মিত। শিশু-কিশোরসহ সব বয়সের মানুষদের পাখি চেনানো ও নিয়মিত পাখি দেখা কার্যক্রম আছে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হকের।
পাখি দেখার প্রতি তার আগ্রহের শুরু আচানক। নিজে একসময় দেশ, বিদেশের পাখি পালতেন। এই শখ ছিল তার। সেই কোন ছোটবেলায় তার গ্রামের বাড়িতে পাখিদের পেছনে ঘুরতো একটি ছোট্ট ছেলে; সেই থেকে পাখিদের মায়ায় পড়ে গেল সে। তারপর অনেকে বলেছেন, আপনার পাখিদের প্রতি আগ্রহ আছে। পাখি পালেন কেন? তিনি পাখি পালা ছেড়ে দিলেন। হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের প্রধান পাখি সংরক্ষক।
ইনাম আল হকের অনেক গুণ। এই দেশের ছেলেমেয়েদের তিনি পাহাড় পর্বতারোহনে প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকা পালন করেছেন। একজন পর্যটক হিসেবে নিজে গিয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম মানুষ হিসেবে এন্টাটিকা মহাদেশে। বরফে ঢাকা সেই মহাদেশ জয়ের কৃতিত্ব আর কারো নেই। ফিরে এসে ধীরে, ধীরে পর্যটনের প্রতি, অভিযানের বিষয়ে বাংলাদেশীদের আগ্রহী করে তুলেছেন। তার মাধ্যমে মুসা ইব্রাহীমের পর্বতারোহণের শুরু। তিনি তাকে হাতে ধরে নিয়ে গিয়েছেন পর্বতাভিযানে। এভারেষ্টের বেস ক্যাম্পেও মুসার পা পড়েছে ইনাম আল হকের নেতৃত্বে। তারপর তিনি প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে এভারেস্ট জয় করলেন। এম এ মুহিত ও নিশাত মজুমদারের এভারেস্ট জয়ের কৃতিত্বও তার। চাঁদা তুলে তাদের বিশ্বসেরা পর্বতারোহী হতে ইনাম আল হক পাঠিয়েছেন নেপালে। নিজের বয়স নেই বলে আগামী দিনের পর্বতারোহীদের এই পথে নিয়ে এসেছেন তিনি।
অক্লান্ত পরিশ্রমী ইনাম আল হক প্রতি বছর জলচর পাখি শুমারি করেন বাংলাদেশে। শুরু করেছেন বহু বছর আগে। তারপর থেকে প্রতি বছরের জানুয়ারি মাসের মধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু মাইল পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের উপকূলাঞ্চলে ও বিভিন্ন হাওড়-বাওড়, নদীতে জীবন বাঁচানোর জন্য বসবাস করা এই পাখিদের তিনি ও তার দল বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের মাধ্যমে শুমারি করে চলেছে। পল থমসন, সৌরভ মাহমুদ, সীমান্ত দীপুদের মতো আজকের তরুণ পাখি পর্যবেক্ষক ও পাখিবিজ্ঞানীদের এবং পরিবেশ লেখককুলের জন্ম ইনাম আল হকের মাধ্যমে। তিনি প্রতি মাসে তার বাসায় এখনো পাখি নিয়ে আলোচনা, আড্ডার আয়োজন করে যাচ্ছেন। নিজেদের চাঁদায় তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রীদের গবেষণার জন্য আর্থিক অনুদান প্রদান করেন।
লেখালেখিতে খুব দক্ষ এই মানুষটি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় খুব স্বাচ্ছন্দ্য। তার বই আছে ব্যাঙামা, ব্যাঙামির মতো যত পাখি ইত্যাদি। প্রতিটি বইই প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, মানুষের অনন্য বন্ধুদের গল্প আর ইতিবাচকতার উদারণ হয়ে থাকবে।