ট্রাভেল কার্যক্রম নিয়ে যাত্রা শুরু ‘হুররে’র
দেশের ট্রাভেল এক্টিভিটি মার্কেট এর ৯০ শতাংশেরও বেশি বুকিং হয় অফলাইনে। প্রযুক্তির দিক দিয়ে দেশ এবং পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেলেও আমাদের দেশের ট্রাভেল এক্টিভিটি মার্কেটে প্রযুক্তির ছাপ পড়েছে কমই। আজকে আপনি যদি বান্দরবনে কোনো এডভেঞ্চারে যেতে চান অথবা সাজেকে বেড়াতে যেতে চান তাহলে এইসব ট্যুর বা সার্ভিস খুব সহজে কিন্তু অনলাইনে বুক করতে পারবেন না। হয় আপনাকে কোনো ট্রাভেল এজেন্সির সহায়তা নিয়ে তাদের অফিসে গিয়ে দেখা করে বুক করতে হবে অথবা বিকাশে বা অন্য কোনো ভাবে পেমেন্ট করে বুক করতে হবে।
কিন্তু এই কাজটিই সহজ করে দিচ্ছে অনলাইন মার্কেট প্লেস হুররে। একদল তরুণ উদ্যোক্তা এই মার্কেট প্লেস তৈরি করেছেন। hurraayy.com থেকে আপনি খুব সহজেই কাংক্ষিত এডভেঞ্চার বা ট্যুর নির্বাচন করে নিরাপদ পেমেন্ট গেইটওয়ের মাধ্যমে পেমেন্ট করে বুক করে ফেলতে পারেন!
বাংলাদেশের অফলাইন ট্রাভেল এক্টিভিটি (এডভেঞ্চার,ক্যাম্পিং,ট্যুর ইত্যাদি)মার্কেটকে ডিজিটাল করার প্রত্যয় নিয়ে সম্প্রতি যাত্রা শুরু করলো ঢাকার ট্রাভেলভিত্তিক প্রযুক্তি স্টার্টআপ হুররে Hurraayy.
ভ্রমণের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো থাকার জায়গা। বাণিজ্যিক হোটেলগুলো দীর্ঘদিন যাবত এই চাহিদা পূরণ করে আসছিল। কিন্তু মানসম্পন্ন বানিজ্যিক হোটেলের সংকট আর অত্যাধিক মূল্যের কারনে ক্রমবর্ধমান ভ্রমণপিপাসুদের চাহিদামত থাকার জায়গার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এইসব বিবেচনা করে হুররে তৈরি করেছে হোম শেয়ারিং প্লাটফর্ম, যেখানে থেকে ট্রাভেলাররা খুব সহজেই বাসা কিংবা এপার্টমেন্ট সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ভাড়া নিতে পারেন। এইসব ব্যাক্তিগত বাসা বা এপার্টমেন্ট ব্যায়বহুল হোটেল এর তুলনায় হবে অনেক সাশ্রয়ী।
হোম শেয়ারিং এ যেমন ট্রাভেলাররা উপকৃত হচ্ছেন একই সাথে যারা শর্ট টার্মে ভাড়া দিচ্ছেন তারাও আয় করতে পারছেন। বহির্বিশ্বে এই হোম শেয়ারিং এর ধারণা নতুন না হলেও বাংলাদেশে এটা মোটামুটি নতুনই বলা চলে।
হুররে'র প্রতিষ্ঠাতা হাসান শহীদ
হুররে’র শুরু যেভাবে
স্টার্টআপটির প্রতিষ্ঠাতা হাসান শহীদ ভ্রমণ করতে খুব ভালোবাসেন। এই শতাব্দীর শুরুর দশকে ঘুরে বেড়িয়েছেন যুক্তরাজ্যে। বাংলাদেশের অলিগলি তো জানাই ছিলো তার। হুররে এর কাজ শুরু করার কিছুদিন পরে তারই বন্ধু শফিউল আলমকে এরকম একটি ধারণা প্রস্তাব করার সাথে সাথেই রাজি হয়ে যান শফিউল। যুক্ত হলেন সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে।
শফিউল বলছিলেন, ‘যখন হাসান বললো যে দেশের ট্রাভেল সেক্টরে এরকম একটা বিপ্লব ঘটানো সম্ভব তখন আমি না করিনি। সানন্দে রাজি হয়েছি। আর তাছাড়া হাসান আর আমার মধ্যে বোঝাপড়া চমৎকার বিধায় একসাথে অনেক দূর যাওয়া সম্ভব বলেই আমি বিশ্বাস করি’।
হাসান শহীদ কাজ করেছেন যুক্তরাজ্য আর বাংলাদেশের খ্যাতনামা কোম্পানীগুলোতে। কাজ করেছেন গ্লোবাল টেলিকম জায়ান্ট হুয়াওয়েতে, ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন বাংলাদেশের সফটওয়ার জায়ান্ট ডেটাসফট-এ। টেকনোলজি এবং ব্যাবসায় নেতৃত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করা হাসান বলছিলেন ‘একদিকে আমরা দুজন একসাথে যেমন প্রচুর ভ্রমণ করি অন্যদিকে আমাদের আছে প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা। এই দুইয়ের মিশেলে আমরা বিশাল কিছু করার চেষ্টায় আছি। আমরা ভ্রমণ করার সমস্যাগুলো ধরতে পেরেছি এবং প্রযুক্তি দিয়ে কিভাবে এগুলো সমাধান করা যায় সেটাও বুঝতে পারছি। এর থেকে ভালো কম্বিনেশন আর কি হতে পারে?’।
প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়তে অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে হাসান আর শফিউলের ঝুলিতে রয়েছে প্রযুক্তি আর প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাবসা নিয়ে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা।
হুররে'র সহ-প্রতিষ্ঠাতা শফিউল
শফিউল আলম দীর্ঘদিন কাজ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানী লিডস কর্পোরেশন-এ। সফটওয়ার ডেভেলাপমেন্ট, প্রজেক্ট ম্যানেজম্যান্ট থেকে শুরু করে মেন্টরশিপ সবই করেছেন সফলতার সাথে।
কিন্তু এত কিছু থাকতে কেনই বা ট্রাভেল নিয়ে কাজ করা? এমন প্রশ্নে হাসান শহীদ শুনালেন তার বাজে অভিজ্ঞতার একটা গল্পঃ ‘২০১৯ সালে একবার দুই বন্ধু মিলে বান্দরবনে একটা এডভেঞ্চার সফরের পরিকল্পনা করলাম। যেহেতু অনলাইন কোনো প্লাটফর্মে বুকিং করা যাচ্ছিলো না তাই ফেইসবুকভিত্তিক এক গ্রুপ খুঁজে পেয়ে তাদেরকে নক দিলাম। তাদের কথানুযায়ী পেমেন্টও করলাম, কিন্তু তারপর থেকে তাদের ফোন বন্ধ, গ্রুপের এডমিন উধাও! এরপরেই মনে হলো যে ট্রাভেল এক্টিভিটি মার্কেট নিয়ে একটা কিছু করতে হবে’।
সারা বিশ্বের মার্কেট যেভাবে প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদেরকেও সেভাবে এগোতে হবে এটা জানিয়ে শফিউল যোগ করেন ‘আমাদের পুরো এক্টিভিটি মার্কেট ম্যানুয়াল প্রসেসে চলছে। পেমেন্ট হচ্ছে ম্যানুয়ালি, বুকিং এর বিস্তারিত কিছু জানা যায় না, কোনো প্রমাণ থাকে না। তাছাড়া সর্বোপরি প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব রয়েছে। তাছাড়া দেখুন আজ যদি আপনি দেশের কোনো জেলা শহরে বেড়াতে যান তাহলে উপযুক্ত থাকার জায়গা পাবেন না। আমরা চাই ট্রাভেলাররা সহজে ভ্রমণ করুক আবার যারা রুম বা বাসা ভাড়া দিবে তারাও যেন আর্থিকভাবে উপকৃত হয়’।
হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানী অনলাইনে সার্ভিস দিচ্ছে। কিন্তু সেটাও মোট মার্কেট সাইজের ১০ শতাংশেরও কম। এখানে কাজের সুযোগ অনেক বেশি জানিয়ে হাসান বললেন ‘শুধু ফেইসবুকভিত্তিক গ্রুপগুলোতেই প্রতিদিন যে পরিমাণ লেনদেন হয় সেটা নিয়েই কাজ করার আছে অনেক। এই এক্টিভিটি মার্কেট বিশৃংখলায় ভরপুর, এখানে আমরা কিছু প্রসেস দাঁড় করাতে চাই, যেন মনে হয় এখানে শৃংখলা আছে। গেস্ট যাতে বুকিং করতে আস্থা পায় সেই চেষ্টাই করছি’।
মার্কেটপ্লেইস হিসেবে যেভাবে এগোচ্ছে হুররে
Accommodations, Adventures এবং Experiences এই তিনটি ভার্টিক্যাল নিয়ে হুররে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। বলে রাখা ভালো হুররে কিন্তু কোনো ট্রাভেল এজেন্সি নয়, তারা নিজেরা ট্রাভেল ব্যাবসা করতে চায় না বরং হুররে হচ্ছে একটি টেকনোলজি স্টার্টআপ যারা ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর গাইড, ট্যুর অপারেটর এর ব্যাবসা কে ডিজিটাল করছে, ট্রাভেলারদের সাথে তাদেরকে অনলাইনে কানেক্ট করিয়ে দিচ্ছে। ট্যুর এজেন্সি বা ট্যুর গাইড এই ক্ষেত্রে বিক্রেতা আর ট্রাভেলাররা হচ্ছেন ক্রেতা। আর হুররে হচ্ছে একটা কমন প্লাটফর্ম।
‘একোমোডেশন’ এর ক্ষেত্রে কেন ব্যাক্তিগত বাসা বাড়ি বা আপার্টমেন্টকে হুররে বেছে নিয়েছে সে প্রসঙ্গে হাসান বলছিলেন ‘হোটেল কিন্তু দিনকে দিন ব্যায়বহুল হচ্ছে, তাছাড়া হোটেল এর অবস্থান বাণিজ্যিক এলাকায় হওয়াতে অনেকেই পরিবার নিয়ে সেখানে থাকতে চান না। আবার হোটেল এর অবস্থান অনেক সময় ভ্রমনকারীদের পছন্দসই জায়গায় হয় না, অন্যদিকে বাসা বাড়ি কিন্তু সুবিধাজনক সব জায়গায়ই রয়েছে যেটা আমাদের মতে একটা বিশাল সুবিধা! তাছাড়া স্থানীয় মানুষকে জানতে হলে, তাদের সাথে মিশতে হবে, তাদের সাথে খেতে হবে, তাদের সাথে যুক্ত থাকতে হবে।’ হোম শেয়ারিং এর ফলে বাসা-বাড়ির মালিক যেমন শর্ট টার্মে ভাড়া দিয়ে উপকৃত হচ্ছেন, ঠিক তেমনি ভ্রমণকারীরাও পছন্দসই জায়গায়, কম খরচে থাকতে পারছেন।
হুররে সম্পর্কে আরো জানতে ভিজিট করুন
হুররে এর এডভেঞ্চার হচ্ছে সেইসব ট্যুর বা এক্টিভিটি যেগুলো একদিনেরও বেশি সময় ধরে চলে। এডভেঞ্চারে সাধারণত থাকা, খাওয়া, সকল প্রকার পরিবহন অন্তর্ভূক্ত থাকে। একেবারে টোটাল একটা প্যাকেজ। প্রতিটি এডভেঞ্চার এর জন্য একজন হোস্ট থাকেন যিনি ট্যুর এর সবকিছু ম্যানেজ করেন, সব সময় সাথে থাকেন।
ভ্রমণ বলতে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ শুধু বুঝেন কক্সবাজার এ গিয়ে হোটেলে থাকা আর সৈকতে নামা- এই ধারণাকে পরিবর্তন করতে চায় হুররে।
শফিউল বললেন ‘ট্রাভেল এক্টিভিটি বলতে যে একটা জিনিস আছে সেটা আমরা জানিই না!’
হাসান যোগ করলেন ‘আমরা অনেকে জানিই না যে এডভেঞ্চার ট্রাভেল বলতে একটা জিনিস আছে। ট্রেকিং করতে করতে গহীন অরণ্যে পৌছে যাওয়া যায়, লোকালয়ের বাইরে যে অসাধারণ একটা জীবন আছে সেটা পাহাড় কিংবা পর্বত অভিযানে না গেলে বোঝা যায় না! তাছাড়া পর্বতারোহনের মতো চিত্তাকর্ষক বিষয়কে আমরা জনপ্রিয় করতে চাই।’
দৃষ্টি যখন অনেক দূরে
দেশের মার্কেট দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও হুররে এর দৃষ্টি কিন্তু অনেক দূরে। সফটওয়্যার এর উপর ভিত্তি করে সার্ভিস দেয়ার সুবিধাটা হচ্ছে আপনি বাংলাদেশে বসেই অন্য দেশে ব্যবসা প্রসারিত করতে পারবেন। হুররে চায় বাংলাদেশের গন্ডি পেরিয়ে এটিকে এশিয়া ইউরোপে ছড়িয়ে দিতে।
হাসান বললেন ‘যদিও সব সময় পরিকল্পনার সাথে কাজের মিল থাকে না, কিন্তু আমরা চাই একটি সফল বিজনেস মডেল দাঁড় করাতে। আমরা যেতে চাই এশিয়া প্যাসিফিকে, তারপরে অবশ্যই ইউরোপের মার্কেট ধরতে চাইবো। তারপর কেন আমেরিকা নয়? কিন্তু প্রথমে অবশ্যই আমাদের দেশের মার্কেটে আমরা আধিপত্য দেখাতে চাইবো।’
/এএস