ক্যাপ্টেন কক্সের দেশে
ভ্রমণবিদ ও দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের প্রতিষ্ঠাতা এবার পরিবারের আশা মেটাতে গেলেন কক্সবাজার। অতি চমৎকার, অসাধারণ সেই বেড়ানোর গল্প লিখছেন মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম
উড়োজাহাজে চড়ে ছুটলাম তিন কন্যা-কনিতা, রাবিতা, বাসিতা ও জীবনসঙ্গী কুলসুমকে নিয়ে ক্যাপ্টেন কক্সের দেশে। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে বেলা ১১টায় উড়োজাহাজ ছাড়ল। কন্যাদের এই প্রথম আকাশ ভ্রমণ। স্বাভাবিকভাবেই ভালোলাগা অন্যরকম। তিন কন্যার উচ্ছ্বাসের রেশ আমাদেরও ছুঁয়ে গেল। আনন্দানুভূতি কাটতে না কাটতেই, ঠিক এক ঘন্টা পর অনেক দূরত্ব এক লহমায় পেরিয়ে কক্সবাজার বিমানবন্দরে নামিয়ে দিল বিমান। মুহুর্তে রাজার হাল থেকে ছিটকে পড়লাম মাটিতে। ছুটলাম প্রজার বেশে অটোতে হোয়াইট বিচ হোটেলে। জ্যাম না থাকায় কলাতলী পৌঁছতে সময় লাগল না বেশি। তাদের রুমে গিয়ে কন্যাদের তর সইছিল না। কতক্ষণে নামবে সমুদ্রের নোনা জলে ওরা বাবাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে। বাবা আবার বিখ্যাত পর্যটক ও লেখক। তাই আর দেরী না করে দুপুরের আহার সেরে নেমে গেলাম তাদের সঙ্গে কলাতলী সাগর সৈকতে।
সাগরের নীলাভ জল সব বয়সীদের টানে বড়। বিশালতা, বিপুল জলের তরঙ্গ তোলা ঢেউ-মানলো না কোনো বারণই। তিন বোন আগে এসেছে কয়েকবার। তবু যেন মনে হলো আমারই-এবারই সাগর ওরা প্রথম দেখলো। সবার ক্ষেত্রেই হয়তো হয় এ রকম। তা না হলে বারবার মানুষ সাগর পাড়ে ছুটে যেত না অভিজ্ঞতায় বুঝলাম। ইচ্ছেমত ঢেউয়ের তালে, লম্পঝম্প করে হোটেলে ফিরলাম সবাই।
খানিকটা জিরিয়ে, ছুটলাম রেডিয়ান্ট ফিস ওয়ার্ল্ডে। কক্সবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্রে। শিশুদের ভীষণ প্রিয়। টিকেট কেটে ঢুকতেই আমার বাচ্চাদেরও চোখমুখে দেখি, আনন্দের ঝিলিক। অ্যাকুরিয়াম ভর্তি অচেনা-অজানা নানান পদের মাছ ঘুরছে। এত ভ্রমণ করি, এত মাছের মেলা দেখি। তারপরও আমার চোখ ছানাবড়া! শিশুদের আনন্দ দেখে শিশু হয়ে গেলাম এই বয়সেও। এ তো মাছেদেরই রাজ্য। পিরানহা, মেকং জায়ান্ট ক্যাট ফিস, জেলি ফিস, অ্যাঞ্জেল ফিসসহ সামুদ্রিক অনেক মাছই রয়েছে। মেকং জায়ান্ট ক্যাট ফিস হলো পৃথিবীতে মিঠা পানির সব চাইতে বড় মাছ। পূর্ণ বয়সের এক একটি মাছের ওজন প্রায় ৩শ কেজি।
রেডিয়ান্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডে শিশুরা সবচাইতে বেশী মজা পেয়েছে পানিতে থাকা মাছগুলোকে ফিটারে ভিটামিন খাইয়ে দিতে পেরে। স্বচ্ছ, সুদৃশ্য অ্যাকুরিয়ামে থাকা, বন্দী, নানান প্রকারের মাছের সঙ্গে পরিচিতি হতে থাকলাম আমরা। দেখতে, দেখতে ফিস ওয়ার্ল্ডে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে দিলাম। খুব ভালো লাগলো আমার। চলে গেলাম বঙ্গেপসাগরের আরেকটি বিখ্যাত সৈকত লাবণী পয়েন্টে। রাতের সৈকত অন্যরকম ভালো ও কষ্ট লাগার। সপ্তাহের মাঝামাঝি, পর্যটকেরও ভিড় কম-জানি। অন্ধকারে সাগরের গর্জন অনুভব করলাম সবাই। চাঁদের রূপালি আলোয় হেঁটে বেড়ালাম। কক্সবাজারের ভ্রমণ পিপাসু ওয়াহিদ শিবলী ভাই এসে হাজির। ভাইয়ের টানে তার সঙ্গে সৈকত লাগোয়া মুক্তমঞ্চে আড্ডা। ভ্রমণ পরিকল্পনা করতেই নতুন জায়গার খোঁজ মিলে গেল দুজনের অভিজ্ঞ মনে। চটপটি-ফুসকা খেয়ে সেদিনের মত সৈকতকে বিদায়।
পরদিন সকালে ছুটলাম স্বপরিবারে মেরিন ড্রাইভ। দরিয়ানগরের এসভিএসএস-স্যাটেলাইট ভিশন সি স্পোটর্সে থামলাম। প্যারা-গ্লাইডিং করলাম আমি। জীবনে প্রথম বেলুনে আকাশে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা। ঠিক যেন ‘অ্যারাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ’। উড়ে, উড়ে অনেক দূর। সাগরের বিশাল জলরাশির উপর শূন্যে ভাসলাম। দুঁদে ভ্রমণবিদ বলে সাহসটি করলাম। অবিশ্বাস্য, রোমাঞ্চকর অনুভূতি হলো। আমি উড়লাম আকাশে আর আমার মেয়েরা বিচ বাইকে চড়ে সৈকতে ঘুরলো। চিরচেনা হিমছড়ি চললাম। কনিতার চাই তেঁতুল, রাবিতার শখ ঝর্ণা, বাসিতা উঠবে পাহাড়ে। আহা, রে আহা, রে-তিন কন্যা তিনদিকে। তাদের গাইড হিসেবে আমি সারাক্ষণ পাশে, পাশে। তিনজনের ইচ্ছে পূরণ শেষে ছুটলাম জালিয়াং পাড়া। অল্প কিছুদিন হলো একটি সি পার্ল ওয়াটার পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। টিকেট কেটে ঢুকতে আমার বাচ্চারা আনন্দে আত্মহারা। মজার, মজার সব ওয়াটার রাইডে যত খুশি ততবার, একই রাইডে বারংবার উঠে খুব তৃপ্তি পেল। শেষ মুহুর্তে গিন্নিও রাইডে চড়ার লোভ সামলাতে পারলো না। এবার ছুটলাম সামুদ্রিক খাবার খেতে। মেরিন ড্রাইভ লাগোয়া বাঁশ, ছন ঘেরা এক রেঁস্তোরাতে ঢুকলাম। রেস্টুরেন্ট নয়, আস্ত বাংলো! উঠোন জুড়ে ফুলের গাছ, ক্যাকটাসও আছে। ভেতরে আলো-আঁধারির খেলা। অর্ডার করতেই ইংরেজ কায়দায় হুকুম তামিল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা স্যার-বলে সার্ভ করলো মচমচা ফ্রাই। বরাবরের মত কাঁকড়া খেয়ে বেশি স্বাদ পেলাম। খেয়ে-দেয়ে হিম, হিম বাতাসে বাইরে না থেকে ফিরে গেলাম রাতের কক্সবাজার হোটেলে।
আমাদের কক্সবাজারের তৃতীয় দিন আজ। রাতে ফিরব শহর ঢাকায়। সকাল, সকাল চলে গেলাম সৈকতে। তখন জোয়ার। ঘোড়ায় সাওয়ারি হয়ে তিন কন্যাসহ আমিও মেতে উঠলাম আনন্দে। মেয়েদের উচ্ছ্বাস দেখে মনে, মনে ভাবলাম, যারা বলেন টাকা হাতের ময়লা, টাকাই জীবনের সবকিছু নয়, তারা হয়তো যাপিত জীবন সম্পর্কে কোন ধারণাই রাখেন না। টাকা ছিল বলেই, আজ কন্যাদের ইচ্ছেগুলো পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে আমি বাবার।
জলকেলিতে প্রায় ঘন্টা তিনেক। সাগরের বিশালতা, হাতছানি পিছনে ফেলে, চলে গেলাম হোটেলে ফ্রেশ হতে। দুপুরের আহার শেষে অটোতে। নেমে, ধীর পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলাম শান্ত, নিরিবিলি ঝাউবনে। সৈকতে মানুষ তেমন নেই। কোলাহলহীন, অন্যরকম, সবসময় ভালোলাগার। ঝাউ গাছগুলোর পাশে, ঝিরঝির বাতাসে দূর অতীতে ফিরে গেলাম। হেঁটে, বসে সময় গড়ালাম। পশ্চিমাকাশে সূর্য হেলেছে। সাগর জলে সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, নান্দনিক টুপ করা ডুব দেখলাম। ফিরতি পথে এগিয়ে গেলাম।
যোগাযোগ : ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে নানা মানের, বিভিন্ন কোম্পানির পরিবহন কক্সবাজার যায়। সরকারিসহ বেসরকারি বেশকটি এয়ারলাইন্স আছে। বাস ভাড়া ১ হাজার টাকা হতে ২৫শ।
থাকা-খাওয়া : সৈকত লাগোয়া নানা মানের প্রচুর হোটেল-মোটেল রয়েছে। কলাতলী সড়কে মাঝারি মানের অনেক। রুম ভাড়া ১৫শ টাকা। খাবারের হোটেল প্রচুর । পছন্দমত বেছে নেয়া যায়।
ছবি : সি পার্ল ওয়াটার পার্ক, বিখ্যাত মেরিন ড্রাইভ রোড, রেডিয়ান্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডের মাছের ভুবন, এসভিএসএস-স্যাটেলাইট ভিশন সি স্পোটর্স প্যারা-গ্লাইডিংয়ের বাংলাদেশী টিম, স্বাদু পানির সবচেয়ে বড় মাছ মেকং জায়ান্ট ক্যাট ফিশ।
ওএস।