দেবতা ঘুমান ওই
অসাধারণ দেবতাখুমে ভ্রমণের দারুণ বৃত্তান্ত লিখেছেন দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম| ছবি তুলেছেন নাজমুল আহমেদ
অনেকদিন হয় যাই-যাই করেও যাওয়া হচ্ছিলো না পাহাড়ি তারাছা নদীর প্রান্তরে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার দেবতাখুমে। শেষে ব্যবসা, সংসার, সবাইকে সামলে সুযোগ মিলে গেল। হাতছাড়া করিনি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রাতের গাড়িতে আমাদের ভ্রমণ সংগঠন ‘দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র বন্ধুরা মিলে ছুটলাম বাংলাদেশের ছাদ বান্দরবানে। ছাদ বলার কারণ, এই দেশের বেশিরভাগ উঁচু পাহাড়গুলো রয়েছে এখানেই।
আমাদের নিয়ে বাস যখন বান্দরবান ঢুকলো, তখন রাতের অন্ধকার কেটে চারপাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। জানালার ফাঁক গলে চোখে মুখে বিশুদ্ধ হাওয়ার ঝাপটা লাগছে। সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যেই বান্দরবান শহরে পৌঁছেছি।
বান্দরবানে আমার বেশ ক’বছর পর আসা। দেখলাম, অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। অটোতে চড়ে সোজা হেটেলে। সাফসুতরো হতে, হতেই চান্দের গাড়ি এসে হাজির। নাশতা করেই রোয়াংছড়ি। ছবির মতো সুন্দর পাহাড়ি, সর্পিল পথ। যেতে, যেতে প্রথমে রোয়াংছড়ি বাজার। সেখানে দেবতাখুম ভ্রমণের ফরম আনুষ্ঠানিকভাবে পূরণ করে ছুটলাম কচ্ছপতলী লিরাগাঁও আর্মি ক্যাম্পে। প্রয়োজনীয় ফর্মালিটি সেরে এবার পায়ে হেঁটে গাইড মিস্টার অঙ্কিনের সঙ্গে চললাম শীলবান্ধা পাড়া। যতই এগিয়ে চলছি, ততই সৌন্দর্যের ঘোরে আচ্ছন্ন হচ্ছি এই আমিও। এই পথটাতে অন্যরকম মায়া আচ্ছন্ন করে রেখেছে। শঙ্খ নদের উপনদী তারাছা। নদীর তীর ধরে প্রায় ঘন্টাখানেক যাবার পর ইঞ্জিন বোটে চড়লাম। না জানার কারণে নদীটাকে অনেকে ঝিরি ভেবে ভুল করে থাকেন। দেবতাখুম যাবার সময় কোথাও, কোথাও তারাছা নদীর বুকের ওপর, কখনো হাঁটু সমান পানি কেটে ভ্রমণপিপাসুদের এগিয়ে যেতে হয়।
নৈসর্গিক পথে আমাদের বোট চলছে। নদীর দুতীরে পাহাড়। পাহাড়গুলোর প্রকৃতির আপন খেয়ালে গড়া ঘনসবুজ অরণ্য আছে। পাহাড়ের ফাঁক গলে আসা হিমেল হাওয়া হাইকিংয়ের ক্লান্তি দূর করেছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বোট চালক আমাদের মানুষের বাজারে নামিয়ে দিলেন! মানুষের বাজার বলছি কারণ, সেখানে ছিল প্রচুর ভ্রমণ পিপাসুদের সমাগম। দে-ছুট বেশির ভাগ সময় নিরিবিলি জায়গাগুলোতে ভ্রমণ করতে, করতে; এখন কোথাও সাধারণ ভ্রমণ পিপাসুদের মিলন মেলা দেখলেই হকচকিয়ে যায়। ব্যপারটি আমাদের জন্য অস্বস্তিকর হলেও দেশের মানুষের মাঝে যে ভ্রমণ নেশা জাগ্রত হচ্ছে, তা ভেবে বেশ আনন্দ পাই। আগতদের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে, দায়িত্বরতদের ঘন, ঘন উচ্চ স্বরে মাইকিং চলছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা? অধিকাংশদের মাঝেই নিয়ম না মানার প্রবণতা আছে। যে কারণেই হয়ত মাত্র কয়েকদিন আগেই তরতাজা একটি প্রাণের সলিল সমাধি। এখন নিরাপত্তা কর্মীরা যথেষ্ট সতর্ক নিয়ম শৃঙ্খলার বিষয়ে। আমরাও স্থানীয় পাড়ার বমদের বাঙ্গালী জামাই রবিউলের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে, সিরিয়াল ব্রেক করার পূর্ব পরিকল্পনা বাদ দিয়ে- নির্ধারিত সময়ের জন্য অপেক্ষায় রয়েছি। এতে প্রায় ঘন্টাখানেক দেরী হলো। তবে নিয়ম মেনে চলছি-এই ভেবে বিরক্ত লাগেনি। এই হলো কাজের মতো আরেকটি কাজ।
আমার সিরিয়াল নাম্বার ১২। ডাক আসতেই লাইফ-জ্যাকেট পড়ে সবাই রেডি। নৌকায় চড়ব নাকি বাঁশের ভেলায়? দ্বিতীয়টি বেছে নিলাম। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা। এরপর সবাই বেশ কয়েকটা ভেলায় ভেসে, প্রত্যেকে নিজে নিজেই মুলি বাঁশের লগিতে বাইতে শুরু করলাম। তারাছা নদীর স্বচ্ছ টলটলে পানিতে আমাদের ভেলাগুলো এগুতে থাকে।
দুপাশে খাড়া হয়ে উপরে উঠে গেছে বিশাল পাথুরে পাহাড়। ওর মাঝ দিয়েই আমরা চলছি। যতোই এগুতে থাকি, ততোই সরু থাকে দেবতাখুমের অভ্যন্তর। আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মানুষেরা গর্তকে খুম বা কুম বলে থাকে। জায়গাটা বিশাল পাহাড়ের মাঝে হওয়াতে, হয়ত তারা একে দেবতা কুম নাম রেখেছে। তারা একে দেবতার মতো পূজা করেন প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাসে। রক্ষণাবেক্ষণও তারাই করেন-প্রকৃতির সন্তানেরা।
ভেলাগুলো ভাসাতে, ভাসাতে একেবারে দুই পাহাড়ের মাঝের সবচাইতে সরু জায়গা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছালাম। এর সৌন্দর্য আরো নয়নাভিরাম। ছোট, বড় অজস্র পাথর প্রাকৃতিকভাবেই ছড়িয়ে, ছিটিয়ে আছে। এ পাশটায় পানির গভীরতা কম কিন্তু প্রবাহের ক্ষিপ্রতা অনেক বেশি। টলটলে পানির নীচের সবকিছুই স্পষ্ট, দৃশ্যমান। সূর্যের আলো এখানে ঠিকমত পৌঁছাতে পারে না। ভরদুপুরেও মনে হলো সন্ধ্যা। এ যেন কোনো মায়াবিনী তার ভালোবাসার চাদর পাহাড় দিয়ে মুড়িয়ে দিতে চাচ্ছে সবাইকে। প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হতে পারা, যে কোনো মানুষের মতো আমাদের ভ্রমণ পাগলদের স্বর্গানুভূতি। মনের অপার্থিব সুখস্বর্গ। একান্তই হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়।
ইচ্ছে ছিল, পায়ে হেঁটে আরো কিছুদূর এগুব কিন্তু দায়িত্ববোধ ও মানবতা বলে কথা আছে আমার ভেতরে। আমরা ফেরার পর, সে ভেলায় চড়ে আরো অনেকেই প্রবেশের অপেক্ষায় আছেন। আর দেরী না করে ফিরতে শুরু করলাম দলে-বলে। নিরাপত্তাকর্মীদের তথ্য মতে, দেবতাকুমের কোথাও, কোথাও ৬০ থেকে ৭০ ফিট পর্যন্ত পানির গভীরতা রয়েছে। সুতরাং সাধু, সাবধান! যতই মায়ার ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন না কেন, লাইফ-জ্যাকেট না পড়ে দেবতাখুমে ঢোকার দুঃসাহস কখনো করবেন না। সবসময় নিজের নিরাপত্তাই আগে মনে রাখবেন। তাতেই সৌন্দর্য সুধা লাভ ঘটে।
যাবেন?
বাসে ঢাকা-বান্দরবান। চাদের গাড়িতে বান্দরবান-রোয়াংছড়ি বাজার। সেখানে স্থানীয় গাইড মিলবে। থানায় নাম-ঠিকানা এন্ট্রি করে চলে যেতে হবে কচ্ছপতলী আর্মি ক্যাম্প। ক্যাম্প হতে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দেবতাখুম যাবার অনুমতি মিলবে। এরপর আর নয়।
খাওয়া?
যাবার সময় কচ্ছপতলী বাজারে পছন্দের কোনো হোটেলে খাবার অর্ডার করে অ্যাডভান্স করে যেতে হবে।
সময়? পয়সা?
যাওয়া-আসা দুই রাত মাঝে একদিন হলে মাত্র তিন হাজার টাকায় দেবতাখুম ঘুরে আসা যাবে।
মুহাম্মদ জাভেদ হাকিমের টিপস
তিনকপি ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি সঙ্গে নিতে হবে। নানা জায়গায় প্রদর্শন করতে হবে। নিরাপত্তাকর্মীদের কথা অমান্য করে লাইফ-জ্যাকেট পরিধান হতে বিরত থাকবেন না, দেবতাখুমে প্রবেশের পর খুলে ফেলবেন না। যারা সাঁতার জানেন না, তাদেরকে দেবতাখুম ভ্রমণে এরপরও বিশেষ সাবধনতা অবলম্বনের অনুরোধ আমার। কোনো গাছগাছালির ক্ষতি করবেন না। প্রকৃতির জন্য বিপদ হবেন না। প্লাস্টিক নিয়ে যাবেন না ও ফেলবেন না।
ওএস।