পেঙ্গুইনের জন্য বুনেছেন সোয়েটার
বেড়াতে গেলে সবারই অ্যান্টার্টিকার পেঙ্গুইনদের দেখতে মন চায়। সেই ছানাগুলোর জন্য তিনি বুনেছেন উলের ছোট্ট সোয়েটারগুলো একের পর এক। অ্যালফ্রেড অ্যালফি ডেটের আরেকটি রেকর্ড হলো তিনি অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বয়সী মানুষ
১১০ বছর ১শ ৭৬ দিনে মারা গিয়েছেন তিনি। তার আগের গিনেজ বুক অব ওয়াল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে প্রবীণ পুরুষের। তবে সেজন্য নয়, অ্যালফ্রেড অ্যালফি ডেট মানব ইতিহাসে নমস্য হয়ে রইবেন নানাভাবে আহত পেঙ্গুইন ছানাদের সুস্থ করতে উলের জাম্পার বুনে। পুরুষ হলেও তিনি মোট ৮০ বছরের উল বোনা ও উলের কাজ করার অভিজ্ঞতাধারী। পেশায় তাঁতী। তবে ওই এই একটি কারণেই যেসব নার্সরা এই ছানাগুলোকে সেবাদান করেন, তিনি অবসর নেবার পর যখন বাড়িতে চলে এলেন, এরপর থেকে নানাভাবে সাহায্য ও খুব সম্মান করতেন। তাদেরও তার কাছ থেকে কাজগুলো শেখার আগ্রহ ছিল খুব। শিখেও নিয়েছেন তারা। তবে তিনি কীভাবে পেঙ্গুইনের ছানাদের দেশের রাজা হলেন? সেজন্য চলে যেতে হবে ২০১৩ সালে। একটি জাহাজ থেকে তেলের ট্যংকার ভেঙে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের পেঙ্গুইনদের অসুস্থ করতে লাগলো, তাদের মেরে ফেলতে শুরু করলো, তখন তিনি কাজে নামলেন। এই দুটি দেশেই থাকে মোট ৩২ হাজার পেঙ্গুইন। এখানেই তাদের কলোনিটি, ওরা দল বেঁধে একটি জায়গাতে বাস করে। নাম ফিলিপ আইল্যান্ড। আছে ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়ান অংশে। এরপর সেখানকার দি ফিলিপ আইল্যান্ড পেঙ্গুইন ফাউন্ডেশন আবেদন করতে শুরু করলো সবাইকে উলের জার্সি তৈরি করে অনুদান দিতে, যাতে বেঁচে যাওয়া পেঙ্গুইন ছানাগুলোকে নিশ্চিত জীবন উপহার দেওয়া সম্ভব হয়। সেই থেকে তারা এভাবে আহত, দুর্বল ও রোগাক্রান্ত ছানাগুলোকে উলের জার্সি পরাচ্ছেন। নানা ধরণের বিষাক্ত পদার্থ, তাদের চটচটে গা ও তেলে পূর্ণ ছোট্ট ডানাগুলোতে নানা বিপদজনক উপাদান লেগে আরো আহত যাতে করতে না পারে। এর আগেও তারা এভাবে সুয়েটার পরে বাঁচিয়েছেন সব ধরণের পেঙ্গুইনকে। ২০০১ সালে আরেকটি ভয়াবহ তেল নির্গমণে মোট ৪শ ৩৮টি পেঙ্গুইন আহত হয়েছে। এভাবে বাঁচানো গিয়েছে ৯৬ শতাংশকেই। সোয়েটার পরিয়ে বাঁচানো ও সুস্থ করা গিয়েছে সেবাটি দিয়ে। ফলে ২০১৩ সালে সেই ঘটনাটি বলে তারা যখন তার কাছে সাহায্যের জন্য এলেন, না করতে পারেননি অ্যালফি। এতে তার কাজ করাও হবে। কেননা, বয়সের ভারে নিজেও নানা ধরণের শারিরীক এবং মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে গিয়েছেন। ফলে তারও নতুন জীবন পাওয়া হলো। পেঙ্গুইন ছানাদের বাঁচানোর এই কাজে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন ও খুব আনন্দ নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন বলে বিরল সম্মানের অধিকারী হয়েছেন। এখনো তার কথা সবাই বারবার মনে করেন। এই উল বোনার কাজ কিন্তু তাকে হাতে-কলমে কেউ শেখাননি। নিজে, নিজে আগ্রহের বশে শিখেছেন। অ্যালফির কাজের শুরু ৩০’র দশকে শ্যালিকার কাছ থেকে শিখে, একজন ভাগ্নে বা ভাগ্নির জন্য ছোট্ট জ্যাকেট বুনতে গিয়ে। তারপর থেকে আর বিরাম নেই। ডুবন্ত ‘টাইটানিক’ জাহাজ এবং ‘বিশ্বযুদ্ধ ১’ ঘোষণার কথাও তার মনে পড়ে। তারপরও এত দিন কীভাবে বেঁচে আছেন? উত্তর করলেন, ‘প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠি। এটিই আমার দীর্ঘজীবন এবং যেকোনো কিছুতে পরিতৃপ্ত হওয়া আমার এই জীবনের আরেক রহস্য।’ ফিলিপ আইল্যান্ড পেঙ্গুইন ফাউন্ডেশনের অনুরোধে পেঙ্গুইন ছানাদের ভালোবেসে একের পর উলের ছোট্ট নানা রঙের ও রঙ বেরংয়ের সোয়েটার বুনে গেলেন অ্যালফি। যখন পর্যাপ্ত বানিয়ে ফেলতে পারলেন পেঙ্গুইন সোয়েটার, তার খুশি আর ধরে না। আরো ভালো লাগলো বলে বন্ধুবান্ধব এবং অপুষ্ট শিশুদের জন্য উলের সোয়েটার বানিয়ে গিয়েছেন। তিনি সামান্য হেসে বলেছেন, ‘একার জীবন কাটানোর জন্য এটি একটি ভালো উপায় বটে।’ ব্যক্তিজীবনে তিনি দুটিবার বিয়ে করেছেন। মোট সাতটি ছেলেমেয়ের বাবা। নাতি-নাতনি আছেন মোট ২০ জন। এই উল শিল্পী একজন ভালো খেলোয়াড়। ১৯৯০’র দশক পর্যন্ত গলফ খেলেছেন। পেশাদার গলফার ছিলেন। ১৯০৫ সালের ৮ নভেম্বর জন্ম নিয়ে অষ্ট্রেলিয়ার এই প্রবীণ মানুষটি এই দিনে ২০১৬ সালে মারা গিয়েছেন। তবে তার জন্ম ইংল্যান্ডে। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ব্রিটেনের রাণী এখনো অস্ট্রেলিয়ায় সাংবিধানিকভাবে প্রধান। জন্মেছেন লন্ডনে। বাবা জর্জ ও মা হ্যারিয়েটের সঙ্গে মোটে ৬ বছর বয়সে ১৯১১ সালে তিনি চলে এলেন তাদের এই উপনিবেশে। তাঁতী পরিবারটি তাতের অভাবে না খেয়ে মরতে বসেছিল, পালিয়ে বাঁচলো ও নতুন জীবন পেল। সেই কাজটি একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে প্রয়োগ করেছেন পেঙ্গুইন ছানাদের জীবন বাঁচানোর জন্য। কাজ করেছেন তারা সবাই পেঙ্গুইন ফাউন্ডেশনের জন্য। ২০১৩ সালে তার ১শ ৮তম জন্মদিন পালন করা হলো। তাকে আবার জাঁকজমকের সঙ্গে জন্মদিনে নিয়ে গেলেন সবাই। তখন গণমাধ্যমে আরো দুটি জন্মদিন পাওয়ার আশা ঈশ্বরের কাছে করেছিলেন অ্যালফ্রেড অ্যালফি ডেট। দুটি বছর এলো। তাকে চমকে দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে এলেন দেশের গভর্নর জেনারেল স্যার পিটার ক্রসগ্রোভ। অ্যালফি মারা দিয়েছেন নিউ সাউথ ওয়েলসের উমিনাতে। তার জীবনের আরো একটি দিক হলো কোনোদিনও কাউকে না বলতে তার ভালো লাগে না।