হারিয়ে যাওয়া এক কিংবদন্তী গেমিং ফোন
একটি স্মার্টফোনকে যে রীতিমতো একটি প্লেস্টেশন হিসাবে ব্যবহার করা যায় সে বিষয়টিও তুলে এনেছে গেমিং ফোন।
স্মার্টফোনের বাজারে একের পর এক নতুন চমক আনছে কোম্পানিগুলো। কেউ স্মার্টফোনে ২০০ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা দিয়ে হইচই ফেলে দিচ্ছে, আবার কেউ ১৪৪ হার্জ রিফ্রেশ রেটের ডিসপ্লে দিয়ে বাজারের সেরা ফোনের খেতাব নিয়ে নিচ্ছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন এক ট্রেন্ড, গেমিং ফোন।
গেমিং ফোনের উত্থান স্মার্টফোন ব্যবহারের ধারণাকে একদম বদলে দিয়েছে। গতানুগতিক কাজের বাহিরে একটি স্মার্টফোনকে যে রীতিমতো একটি প্লেস্টেশন হিসাবে ব্যবহার করা যায় সে বিষয়টিও তুলে এনেছে গেমিং ফোন।
একটি গেমিং ফোনের মালিক হওয়ার ইচ্ছা তরুণ-তরুণীদের এক স্বপ্নে রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে গেমপ্রিয় নেটিজেনদের মৌলিক চাহিদায় রূপান্তর হয়েছে একটি শক্তিশালী গেমিং ফোন। এই ট্রেন্ডে দিন দিন বাড়ছে গেমারের সংখ্যা, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন গেমিং প্ল্যাটফরম, সেই সঙ্গে প্রযুক্তি খাতের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কোম্পানিগুলো একের পর এক আনছে নতুন সব গেমিং ফোন।
শুধু তা-ই নয় বাজার টিকিয়ে রাখতে এবং গেমারদের আরও আগ্রহী করতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে সেরা খেলোয়াড়দের লাখো ডলার পুরস্কারও দেওয়া হচ্ছে।
বাজারে এখন অসংখ্য গেমিং ফোন। যাদের মাঝে নেতৃত্ব ধরে রেখেছে আসুসের রগ ফোন, শাওমির ব্ল্যাক শার্ক, জেডটিই এর নুবিয়া রেড ম্যাজিক এবং লেনোভোর লিজিয়ন ফোন। এ ছাড়া প্রায় সব কোম্পানির গেমিং করার মতো পারফরম্যান্সের ফোন বাজারে আছে।
গেমিং স্মার্টফোনগুলোর বৈশিষ্ট্য আর দশটা সাধারণ ফোন থেকে একটু আলাদা হয়। এর জন্য চায় শক্তিশালী প্রসেসর, অধিক ধারণক্ষমতা-সম্পন্ন র্যাম, দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি এবং বড় ও স্মুদ ডিসপ্লে। এর বাইরে যে কোম্পানি যত বেশি ফিচার দিতে পারবে সে কোম্পানিই তার ফোন বাজার টিকিয়ে রাখতে পারবে। এ কারণে এই ফোনগুলোর বাজারমূল্য অন্য ফোনগুলোর তুলনায় বেশি।
গেমিং ফোনের প্রচলন খুব বেশিদিন নয়। প্রায় চার বছর আগে, ২০১৭ সালে। যদিও বিশ্ববাজার গেমিং ফোনের ট্রেন্ডে আসতে শুরু করে ২০১৮ সালে, তাও সীমিত ফিচার নিয়ে। তখন শাওমি, আসুস, ওয়ানপ্লাসসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি প্রতিযোগিতা করে বাজারে গেমিং ফোন এনেছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে একটি কোম্পানি তখনকার বাজারে অনেক বেশি ফিচার নিয়ে গেমিং ফোন বানিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল।
বলছিলাম ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে বাজারে আসা বিশ্বের প্রথম ১২০ হার্জ ডিসপ্লের গেমিং স্মার্টফোন 'রেজার ফোন'এর কথা।
ফোনটি বাজারে এনেছিলো সিঙ্গাপুর-আমেরিকার যৌথ বাণিজ্যিক কোম্পানি বিখ্যাত কম্পিউটার হার্ডওয়্যার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান 'রেজার ইনকর্পোরেটেড'। বিশ্বজুড়ে রেজার এর খ্যাতি তাদের উচ্চক্ষমতা-সম্পন্ন গেমিং ল্যাপটপের জন্য। গেমিং পারফরম্যান্সে রেজারকে টেক্কা দিতে অন্য কম্পিউটার কোম্পানিগুলোর রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়।
রেজার ফোন নিয়ে বিখ্যাত প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের একবাক্যে মতামত ছিল অনেকটা এরকম 'এই স্মার্টফোনটি ভবিষ্যৎ থেকে নিয়ে আসা'।
২০১৭ সালে রেজার ফোনে ব্যবহার করা হয়েছিলো স্ন্যাপড্রাগন ৮৩৫ প্রসেসর (২.৪৫ গিগাহার্জ) যাকে সহযোগিতা করার জন্য ছিল ৮ গিগাবাইট র্যাম। একইসঙ্গে চূড়ান্ত ফলাফল সর্বোচ্চ ভালো দিতে আরও ছিল ১২০ হার্জ রিফ্রেশ রেটের মাখন মসৃণ আইপিএস এলসিডি ডিসপ্লে। একই সময়ে এলজি, শাওমি, সনিসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি একই প্রসেসর ব্যবহার করলেও সেই ফোনগুলোর কোনোটিই ভারী গেমিং-এর জন্য উপযুক্ত ছিল না। সহায়ক হিসাবে চার ও ছয় গিগাবাইটের র্যাম থাকলেও ১২০ হার্জের ডিসপ্লে ছিল কল্পনাতীত।
ফোনটির ৫.৭ ইঞ্চি আকৃতির ডিসপ্লেটির রেজুলেশন ১৪৪০X২৫৬০ (2k)। যার সুরক্ষা দিতে ব্যবহার করা হয়েছে কর্নিং গরিলা গ্লাস থ্রি। সম্পূর্ণ অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমের এই ফোনে সর্বপ্রথম 'সাইড মাউন্টেড ফিঙ্গার প্রিন্ট সেন্সর অন পাওয়ার বাটন' প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ফোনটিতে লাউড স্পিকার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে দুটি ডলবি অ্যাটমস স্টেরিও স্পিকার। যদিও ৩.৫ মিলিমিটার অডিও জ্যাক ছিল না, কিন্তু টাইপ সি চার্জিং পোর্ট থাকায় ইয়ারফোন ব্যবহারে তেমন কোনো অসুবিধাও হয়নি।
অ্যান্ড্রয়েড ৭.১.১ নোগাট অপারেটিং সিস্টেমে ফোনটি পরিচালিত হলেও তা অ্যান্ড্রয়েড ৯.০ পাই অপারেটিং সিস্টেম পর্যন্ত আপগ্রেড করার ব্যবস্থা ছিল, অর্থাৎ দীর্ঘসময় ফোনটি তার ব্যবহারকারীকে সফটওয়্যার আপডেট দিয়েছে। ফোনটির প্রাইমারি ক্যামেরা হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে ১২ মেগাপিক্সেল করে দুইটি ইমেজ সেন্সর। যার একটিতে আছে ২.৬ অ্যাপারচারের বেসিক লেন্স এবং অপরটিতে আছে ১.৮ অ্যাপারচারের ওয়াইড লেন্স। সেলফি ক্যামেরা হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে ৮ মেগাপিক্সেলের ইমেজ সেন্সর।
১৯৭ গ্রাম ওজনের এই ফোনটিতে পাওয়ার সাপ্লাই হিসাবে থাকছে একটি চার হাজার মিলি এম্পিয়ারের লি-পলি ব্যাটারি। মজার বিষয় হলো বিশ্ব বাজারে ২০১৯-২০ সালের দিকে ফাস্ট চার্জিং ট্রেন্ড চালু হলেও রেজার ফোন ২০১৭ সালেই ১৮ ওয়াটের ফাস্ট চার্জিং-এর ব্যবস্থা করেছিল, তাও আবার কুইক চার্জ ফোর প্লাস ক্যাটাগরিসহ। যা ২০২১ সালে বাজারে আসা স্মার্টফোনগুলোতে ব্যবহার শুরু হয়।
২০১৮ সালের প্রথমদিকে প্রযুক্তি বাজারে নেতৃত্ব দেওয়া ওয়ানপ্লাস ফাইভ টি, পোকো এফ ওয়ান, শাওমি ব্ল্যাক শার্ক, আসুস রগ ফোনসহ অনেক স্মার্টফোনই গেমিং জগতে পদার্পন করেছে কিন্তু রেজার ফোন-এর মতো ফিচার দিতে পারেনি কেউ। বরং ২০১৮ সালের অক্টোবরে একই কনফিগারেশনে প্রসেসর আপডেট করে স্ন্যাপড্রাগন ৮৪৫ (২.৮ গিগাহার্জ) নিয়ে রেজার হাজির হয়েছিলো নতুন রূপে। জন্ম নিয়েছিল গেমিং ফোনের জগতে আরেক কিংবদন্তী 'রেজার ফোন টু' এর। তবে এখন তা কেবল ইতিহাস।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রেজার ঘোষণা দিয়েছিল ব্যবসায়িক জটিলতার কারণে তাদের কয়েকটি পণ্য উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হবে। ফলশ্রুতিতে 'রেজার ফোন থ্রি' বাজারে আসার কথা থাকলেও তা আর হয়নি। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে এখনও 'রেজার ফোন টু' কিনতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৫০ হাজার টাকা।
বাংলাদেশের বাজারে প্রবাসীদের মাধ্যমে হাতে গোনা কয়েকটি রেজার ফোন ঢুকলেও উচ্চমূল্য ও তথ্য স্বল্পতার কারণে ফোনটি পরিচিতি পায়নি।
/এএস