‘আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান’ পংক্তিটি হয়তো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কর্তাদের খুবই পছন্দ। তাই তারা জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের দিয়ে একবার কবিগুরুর পংক্তিটিকে বাস্তবে নামিয়ে আনলেন। সেন্ট লুসিয়া থেকে সাইক্লোন পরবর্তী প্রায় পাঁচ ঘন্টার আটলান্টিকের উত্তাল সাগর পাড়ি দিতে নামিয়ে দেওয়া তো সেটারই নামান্তর। এই সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে, তা তাদের খেলোয়াড়ি জীবনে বিরল।
উত্তাল সাগরে কয়েক ফুট উচ্চতার ঢেউয়ে ফেরি প্রচণ্ডভাবে নেচে উঠা সইতে না পেরে ক্রিকেটারদের মধ্যে ভয় ডুকে যায়। নুরুল হাসান সোহান, শরিফুলের উপর দিয়ে ধকল গেছে বেশি। বমি বমি করতে তাদের প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত। অস্থিরতার মাত্রা সইতে না পেরে দু'জনই গায়ের জামা খুলে ফেলেন। মাহমুদউল্লাহসহ কয়েকজনকেও বেশ কাবু করেছিল। যদিও তারা বমি করেননি। কয়েকজন ভয়ে ফেরির ডেকে শুয়ে পড়েন। কেউ কেউ ঘুমিয়ে ভয়ংকর সময়টা পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেন। মোট কথা দিনের আলোতে এই ভ্রমণ মাহমুদউল্লাহদের জীবনে নেমে এসেছিল ঘোর অন্ধকার। সতীর্থদের এমন অবস্থা দেখে মাহমুদউল্লাহ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি। ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রশ্ন করে জানতে চান এ লাইবিলিটি কে নেবে। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায় তিনি বলছেন, ‘আপনারা প্লেয়ারদের অবস্থা দেখেন। এর লাইবিলিটি কে নেবে? এখনো আপনার টু অ্যান্ড হাফ আওয়ার বাকি (মার্টিনেক থেকে ডোমিনিকা) আছে। ওইটার অবস্থা আরও খারাপ।’ তিনি আরও বলেন, ‘চার-পাঁচজন ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। বাকিরা সব ফ্লাট। কেউ ভয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় নেই।’
কিন্তু প্রশ্ন হলো ক্রিকেটারদের কেন এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হলো? এর দায় কার? যখনই দ্বি-পাক্ষিক সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, এর সম্পূর্ণ পরিকল্পনা করে থাকে স্বাগতিকরা। এক্ষেত্রে সবকিছু করেছে উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড। তারা যখন এ প্ল্যান করেছিল, তখনই বিসিবিকে জানিয়েছিল সমুদ্রপথে এই যাত্রার কথা। বিসিবির পক্ষ থেকে প্রথমে সম্মতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে যখন উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড আবারও বিসিবির সঙ্গে যোগাযোগ করে জানায় যে, সিরিজ সংশ্লিষ্ট সবাই এই ফেরিতে যাবে, তখন আর বিসিবির দ্বিমত করার সুযোগ ছিল না বলে ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান বিসিবির সিইও নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজন।
তিনি বলেন, ‘করোনা পরবর্তী পরিস্থিতির কারণে ক্যারিবীয় অনেক রাষ্ট্রে তাদের ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে যেগুলো চলাচল করে তা খুবই ছোট। এসব বিমানে আমাদের ক্রিকেটারদের তাদের মালামাল নিয়ে ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। তাই আমরা উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। তাছাড়া উইন্ডিজের ক্রিকেটারসহ সিরিজের সঙ্গে জড়িত সবাই যাবে এই ক্রুজে।’
বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজন দলের লজিস্টিক ম্যানেজারের কাছ থেকে বার্তাটি পেয়েছিলেন বলে জানান। বার্তা পাওয়ার পরপরই তিনি উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নানান জটিলতায় সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, ‘আমাকে দলের ম্যানেজার কয়েকজন ক্রিকেটারের অসুস্থ হওয়ার খবর জানিয়ে বলেন যে, তারা এভাবে (মার্টিনেকে ৪০ মিনিটের যাত্রা বিরতিতে) যেতে চাচ্ছেন না। এখানে (মার্টিনেকে) নেমে পরে বিমানে যেতে চাচ্ছেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের সিইওর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি তখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। সেখানে তিনি আমার সঙ্গে ও নাফিস ইকবালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি জানান যে, এটি (মার্টিনেক) ফ্রেঞ্চ কলোনি। এখানে ভিসা লাগবে। বিমানের টিকিট পেতেও সমস্যা হবে। এত দ্রুত সবকিছু করা সম্ভব হবে না। পরে ক্রিকেটাররা আবার রওনা দেন এবং নিরাপদেই গিয়ে পৌঁছেন।’ বিসিবির প্রধান নির্বাহী ঘটনা জানার পর থেকে ডোমিনিকা পৌঁছা পর্যন্ত প্রায় তিন ঘণ্টা সার্বক্ষণিক দলের সঙ্গে যোগাযোগে ছিলেন বলেও জানান।
নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজন ঘটনাটিকে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের কাছে যেমন আমাদের ক্রিকেটাররা গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তাদের কাছেও তাদের ক্রিকেটাররা গুরুত্বপূর্ণ। কোনো রকমের ঝুঁকি থাকলে নিশ্চয় তারা এ রকম ব্যবস্থা করত না। আবহাওয়ার কারণে হয়তো এ রকম হয়ে থাকতে পারে। এ রকম ক্রুজে ভ্রমণ সেখানে নিয়মিত হয়ে থাকে। এমন নয় যে আমাদের জন্য আলাদা করে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। দলের সবাই কিন্তু অসুস্থ হননি। কয়েকজন হয়েছেন। বাসে ভ্রমণ করার সময়ও কিন্তু অনেকেই বমি করে থাকেন। পরে (মাটিনেক থেকে ডোমিনিকা) কিন্তু আমাদের কারও আর কোনো সমস্যা হয়নি। সাকিব ছাড়া বাকি সব ক্রিকেটাররা রাতে ডিনারেও অংশ নেন।’
এমপি/এসজি/