‘আগে যারা আব্বু আম্মুকে কটু কথা বলতো, তারাই এখন এসে ভালো কথা বলে’
ছবি মার্জ : ঢাকাপ্রকাশ
‘ছোট বেলা থেকেই ফুটবল দেখলে নিজের ভিতর অন্য রকম অনুভুতি কাজ করতো। আমার গ্রামে কোন মেয়ে না থাকায় আমার সমবয়সী সব বন্ধু-বান্ধব, ভাই, ভাতিজা ওদের সাথেই খেলতে যেতাম। তার জন্য আব্বু-আম্মুর অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে। মাঝে মধ্যে ছেলেদের সাথে খেলতে যাওয়ায় মানুষের কটু কথায় আম্মু অনেক মাইর দিছে তবুও ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা আমাকে আটকে রাখতে পারতো না ঘরে। আব্বুর সাপোর্ট ছিলো আগে থেকেই, কিন্তু আম্মু যখন বারণ করেও আমায় আটকে রাখতে পারেনি তখন থেকে আম্মু ও সাপোর্ট করতো। আগে যে মানুষগুলো আব্বু আম্মু কে কটু কথা বলতো তারাই এখন এসে ভালো কথা বলে।’
নওগাঁ জেলার প্রথম প্রমীলা ফুটবলার হিসেবে বাংলাদেশ সাফ প্রমীলা ফুটবল দলের পক্ষে নেপাল খেলতে যাওয়ার পূর্বে আইরিন খাতুন ঢাকাপ্রকাশকে এভাবেই বলছিলেন নিজের অনুভূতি আর প্রত্যাশার নানা কথা।
আইরিন খাতুন বলেন, ‘আমার কোন টিম ছিলো না, আর আমাদের গ্রামে এখন পর্যন্ত কোন মেয়েদের টিম হয় নাই। টিম না থাকায় কোথাও খেলতে পারতাম না, অনুশীলন ও হতো না। পরে নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার ডাকবাংলো মাঠে আলম ভাই ছেলেদের অনুশীলন করাতো ওখানেই যেতাম মাঝে মধ্যে। প্রতিদিন যাওয়া সম্ভব হতো না, আমার বাড়ি থেকে অনেক দূরে ছিলো মাঠ এবং আব্বুর সামর্থ্যও ছিল না। তখন ও অনেক মানুষের অনেক কতা শুনতে হতো বুঝেন-ই তো গ্রামের মানুষ।’
আইরিন বলেন, “একদিন আমাদের এলাকার পাশে মেয়েদের দুইটা টিমের প্রীতি ম্যাচ ছিলো। আমি জানার পর আমার বাবাকে বলছিলাম ওই টিমে আমি খেলতে পারবো কি না একটু কথা বলার জন্য। বাবা অনেক লাজুক প্রকৃতির মানুষ লজ্জা পায় অনেক, আমাকে বললো ওরা যদি অপমান করে, তোমাকে খেলতে না দেয়। তখন আমি বললাম বাবা তুমি একবার বলেই দেখো। তখন বাবা অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বললো, তোমার বড়আব্বু তো একজন শিক্ষক সে ভালো করে বুঝায় বলতে পারবে আমি ওনাকে বলে দেখি উনি কথা বললে হয়তো ভালো হবে। তারপর আব্বু কল দিলো আমার বড়আব্বুকে, সে কল রিসিভ করে শুনার পরে বললো তার কাজ আছে সে যেতে পারবে না! অজুহাত ছিলো মাত্র, সে কিন্তু বিকেলেও খেলা দেখতে গেছিলো! ( বড়আব্বুর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)। তারপর আব্বু কল কেটে দিয়ে সাহস করে আমাকে নিয়ে ওই টিমের উদ্দেশ্য রওনা দিলো, টিমের কোচের সাথে কথা বললো, বলার পর কোচ আমাকে টিমের সাথে রেখে মাঠে নেয় এবং বলে আমার গ্রামেই যেহেতু খেলা তাই তিনি আমাকে হাফ টাইমের পর মাঠে নামাবেন। আমিও খুব খুশি হইছিলাম। হাফ টাইমের পর আমাকে মাঠে নামায় এবং আমার খেলা দেখে কোচ খুশি হয়। খেলা শেষে কোচ ( মো. বেলাল হোসেন,দিনাজপুর) আমাকে বলে, পরে কোন খেলায় আমাকে ডাকলে আমি খেলবো কি না। আমি এক কথায় উত্তর দিলাম আমি অবশ্যই যাবো। কারন এতদিন পর আমি একটা টিম পাবো ভাবতেই খুশি লাগছিলো। পরে যখন কোন খেলা হতো তখনি আমাকে ডাকতো এবং আমিও খেলতে যেতাম, কখনো আম্মু আবার কখনো আব্বু সাথে যেতো। কিছুদিন দিনাজপুরেও প্রাক্টিস করেছি। বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব ১৭ খেলেছি। পরে কোচ(বেলাল হোসেন, দিনাজপুর) আমাকে ঢাকা লীগে খেলার ব্যাবস্থা করে দেন।”
আইরিন খাতুন বলেন, ‘প্রথম লীগে ইনজুরির কারনে দুই ম্যাচে খেলছিলাম তাও ১০ মিনিট মতো হবে। তারপর আবার রাজশাহী বিভাগের হয়ে ঢাকাতে অনুর্ধ ১৭ খেলি। ওখান থেকে ৪০ জনকে বাছাই করে বিকেএসপিতে একটা ক্যাম্প করা হইছিলো, ওখান থেকে ১৫ জনকে স্পেনে পাঠানোর কথা ছিলো। ১৫ জনের মধ্যে ১জন আমিও ছিলাম। এই খবর শুনে আমাদের উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমাকে একটা সাইকেল উপহার দিয়েছিলো। এখন কিন্তু আগের উপজেলা নির্বাহী অফিসার নেই, বদলি হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বার নিজেই টিম খুজে নিয়েছিলাম এবং লীগের প্রতিটি ম্যাচ প্রথম ১১ তে খেলেছিলাম, ক্লাবের কোচ আমার খেলা অনেক পছন্দ করতো। তারপর ১বছরেরও বেশি সময় লীগ বন্ধ ছিলো। আবার লীগ শুরুর কথা চললে আগের কোচ আমার কাছে আবদার করে এবং অনেক অনুরোধ করে শেষবার তাদের ক্লাবে খেলতে। অনেকবার বলাই আমি না করতে পারিনি, ওই ক্লাবেই আবার খেলি এবং বাংলাদেশ বয়ঃভিত্তিক জাতীয় দলে খেলার জন্য নির্বাচিত হই। ওই বছরে আমি আমার ক্লাব টিমের অধিনায়ক ছিলাম। বয়ঃভিত্তিক জাতীয় দলে খেলার পর চ্যাম্পিয়ন হই অনুর্ধ ২০ এ, তারপর থেকেই বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা দলের ক্যাম্পে থেকে অনুশীলন চালিয়ে গেছি এবং এবার সাফ ওমেন্স চ্যাম্পিয়নশীপ ২০২৪ খেলতে এসেছি।’
শিক্ষা জীবন কোথায় থেকে শুরু প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমার জন্মস্থান নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ২নং হাতুড় ইউনিয়নের সাগরইল গ্রামে। বাবা কৃষক আব্দুল আলিম ও মা গৃহিণী ফিরোজা বেগম। বেড়ে উঠা গ্রামে, খেলা শুরুটাও মহাদেবপুরেতে। সব কিছুই মহাদেবপুর কেন্দ্রিক। আমার প্রাথমিক স্কুল জীবন সাগরইল এবতেদায়ী মাদ্রাসা এবং জাহাঙ্গীরপুর মডেল হাই স্কুল মহাদেবপুর থেকে এইচএসসি পাশ করি। ময়মনসিংহ তারাকান্দা ভাষা সৈনিক শামসুল হক কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী। সবাই আমার জন্য এবং আমাদের টিমের জন্য দোয়া করবেন যাতে আমরা বাংলাদেশকে আরো একটি ট্রফি উপহার দিতে পারি।’